Faith Consequences & Foundations Bengali | ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি

Faith: Foundations & Consequences 1 Bengali Language - About Islam | ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (১)


অনুবাদক: কামাল উদ্দীন মোল্লা
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
More Source: Islamhouse.com

Faith: Foundations & Consequences 1 Bengali Language About Islam ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (১):

ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি 
পরিভাষায় ঈমান হলো, আত্মার স্বীকৃতি, মৌখিক স্বীকৃতি এবং আত্মা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। আর ভালো কাজে ঈমান বৃদ্ধি পায়, মন্দ কাজে ঈমান হ্রাস পায়।
ঈমানের রুকনসমূহ:
যে সকল ভিত্তির ওপর ঈমান প্রতিষ্ঠিত তার সংখ্যা মোট ছয়টি বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

Faith Foundations & Consequences Bengali language ঈমান বুনিয়াদ ও পরিণতি

Faith: Foundations and Consequences 1 Bengali Language - About Islam | ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (১)


 «الإيمان: أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الأخر ونؤمن بالقدر خيره وشره» 
১. আল্লাহর ওপর ঈমান আনা। ২. তাঁর ফিরিশতাদের ওপর ঈমান আনা। ৩. তাঁর কিতাবসমূহের ওপর ঈমান আনা। ৪. তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের ওপর ঈমান আনা। ৫. শেষ দিবসের ওপর ঈমান আনা। ৬. তাকদীরের ভালো ও মন্দের ওপর ঈমান আনা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯)
ঈমানের শাখাসমূহ: 
ঈমানের ৭৭ টির বেশি শাখা রয়েছে। সর্বোত্তম শাখা এ স্বীকৃতি প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই। আর ঈমানের নিকটতম শাখা হলো কষ্টদায়ক বস্তু পথ থেকে অপসারণ করা এবং লাজুকতা ঈমানের অংশ। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
সালাফে সালেহীনের নিকট ঈমানের মৌলিকতা:
প্রথমত: আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন। 
আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন চারটি বিষয় দ্বারা পূর্ণাঙ্গ হয় বলে সালাফে সালেহীন মনে করেন:
১. আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস।
২. আল্লাহর রুবুবিয়্যাতে বিশ্বাস। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহই সবকিছুর সষ্ট্রা। তিনি সব কিছুর প্রকৃত মালিক, সব কিছুর প্রতিপালন তিনিই করেন।
৩. আল্লাহর উলুহিয়্যাতে বিশ্বাস। অর্থাৎ আল্লাহই একমাত্র ইলাহ বা উপাস্য। এ ক্ষেত্রে কোনো মর্যাদাবান ফিরিশতা বা আল্লাহ প্রেরিত কোনো নবী-রাসূলের অংশিদারিত্ব নেই।
৪. আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন। এর ধরণ হলো, কুরআনুল কারীম এবং হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলী বান্দা শুধু তার জন্যই নির্ধারণ করবে। বর্ণনার অবিকল বিশ্বাস স্থাপন করবে, ঐভাবেই তাকে ডাকবে। কোনো প্রকার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধনের আশ্রয় নিবে না এবং তার কোনো প্রতিচ্ছবির কল্পনাও সে করবে না। 
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ﴾ [الشورا: ١١]
“তার মতো কিছু নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”। [সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১১]
আল্লাহর ওপর ঈমান স্থাপনের ফলাফল:
চারটি নীতিমালার আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা যাবতীয় কল্যাণ ও সৌভাগ্যের মূল এবং ঈমানের অবশিষ্ট রুকনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে বিষয়টি পূর্ণতা পায়। উল্লিখিত নিয়মাবলী অনুসারে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখা কর্তব্য। যখনই কোনো জাতি বা গোষ্ঠি আল্লাহর ওপর ঈমানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি মৌলিক নীতিমালার প্রতি দৃকপাতে অবহেলা প্রদর্শন করেছেন, তখনই তাদের অন্তর নিমজ্জিত হয়েছে গহীন অন্ধকারে। তারা পথভ্রষ্ট ও লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে এবং ঈমানের অপরাপর ভিত্তির ক্ষেত্রে ও সত্যের অনুসরণ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: ফিরিশতাগণের ওপর ঈমান: 
ফিরিশতাগণ গায়েবী জগতের অধিবাসী। আল্লাহ তাদেরকে নূর বা জ্যোতি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকে তার আদেশের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের যোগ্যতা এবং তার আদেশ বাস্তবায়নের শক্তি-সামর্থ্য দান করেছেন। প্রভু অথবা উপাস্য হওয়ার নূন্যতম কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের নেই। তারা হলেন সৃষ্ট। আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং মর্যাদা দিয়েছেন তার সম্মানিত বান্দা হিসেবে। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মানুষের সাথে তাদের কোনো মিল নেই। তারা পানাহার করেন না, ঘুমান না, বিবাহের প্রয়োজন নেই তাদের। যৌন চাহিদা থেকে তারা মুক্ত, এমনকি যাবতীয় পাপাচার থেকেও। মানুষের নানা আকৃতিতে আত্মপ্রকাশে তারা সক্ষম।
চারটি বিষয়ের মাধ্যমে ফিরিশতার ওপর ঈমান পূর্ণ হয়: 
১. আল্লাহ তাদের যে সকল গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন সে অনুসারে তাদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন।
২. কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা তাদের যে সকল নাম আমরা জেনেছি, সেগুলো বিশ্বাস করা, যেমন জিবরীল, ইসরাফীল, মিকাঈল, মালিক, মুনকার, নাকীর এবং মালাকুল মাউত ফিরিশতাবৃন্দ এবং তাদের মধ্য থেকে যাদের নাম আমাদের জানা নেই তাদের ওপরও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা। 
৩. তাদের মধ্য থেকে যার বৈশিষ্ট্যের কথা কুরআনে এবং বিশুদ্ধ হাদীসে আমরা জেনেছি, তার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা। যেমন, জিবরীল আলাইহিস সালামের বৈশিষ্ট্য -তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেছেন, যে আকৃতিতে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন অবিকল সে আকৃতিতে। যিনি তার ছয়শত ডানায় আচ্ছাদিত করেছিলেন দিগন্ত। এমনিভাবে ‘আরশ বহনকারী ফিরিশতার বৈশিষ্ট্য এই যে তার এক কান হতে অপর কানের দূরত্ব হলো সাতশত বছরের পথ। সুবহানাল্লাহ!
৪. তাদের মধ্য থেকে যাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা অবগতি লাভ করেছি, তা বিশ্বাস করা। যেমন, ক্লান্তিহীনভাবে দিনরাত তারা আল্লাহর তাসবীহ পাঠে নিমগ্ন থাকেন। কোনো প্রকার অবসাদ তাদের স্পর্শ করে না। তাদের মধ্য রয়েছেন, আরশবহনকারী, জান্নাতের প্রহরী এবং জাহান্নামের রক্ষী। আরো আছেন এক ঝাক ভ্রাম্যমান পবিত্র ফিরিশতা, যারা আল্লাহর আলোচনা হয় এমন স্থানসমূহকে অনুসরণ করেন।
কতিপয় ফিরিশতার বিশেষ কাজ:
• জিবরীল: অহী আদান প্রদানের দায়িত্বশীল এবং নবী রাসূলের নিকট অহী নিয়ে অবতরণের দায়িত্ব তার প্রতি ন্যস্ত করা হয়েছে।
• ইসরাফীল: পুনরুত্থান দিবসে সিংগায় ফূৎকারের দায়িত্ব তার প্রতি ন্যস্ত হয়েছে।
• মিকাঈল: বৃষ্টি ও উদ্ভিদ উৎপন্নের দায়িত্বশীল।
• মালিক: জাহান্নামের দায়িত্বশীল।
• মুনকার এবং নাকীর: তাদের উভয়ের প্রতি কবরে মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।
• মালাকুল মাউত: রূহ কবজের দায়িত্ব তার।
• আল মু‘য়াক্কিবাত: বান্দাদের সর্বাবস্থায় রক্ষার দায়িত্ব তাদের।
• কাতিবুনে কিরাম: আদম সন্তানদের দৈনন্দিন আমল লেখার কাজে তারা নিয়োজিত।
এছাড়া আরো অনেক ফিরিশতা আছেন, যাদের আমল সম্পর্কে আমরা অবগত নই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يَعۡلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَۚ وَمَا هِيَ إِلَّا ذِكۡرَىٰ لِلۡبَشَرِ ﴾ [المدثر: ٣١]
“আপনার প্রভুর বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। এ তো মানুষের জন্য উপদেশ মাত্র”। [সূরা আল-মু্‌দ্দাসসির, আয়াত: ৩১]
ফিরিশতাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপনে রয়েছে মুসলিমদের ব্যক্তি জীবনের নানা উপকারিতা:
 তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. আল্লাহর বড়ত্ব এবং শক্তি সম্পর্কে জানা। কারণ সৃষ্টির বড়ত্ব সষ্ট্রার বড়ত্বের প্রমাণ বহন করে।
২. আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহের জন্য কায়মনোবাক্যে এ শুকরিয়া জ্ঞাপন করা যে, তিনি ফিরিশতা নিয়োজিত করে মানুষকে রক্ষা করেছেন বিভিন্ন আপদ-বিপদ থেকে; তাদের আমলগুলো লিপিবদ্ধ করা, ‘আরশে তাদের দো‘আ পৌঁছে দেওয়া, তাদের জন্য ইস্তেগফার, পুরস্কারের সংবাদ দান ইত্যাদি দায়িত্বগুলো তাদের কাঁধে অর্পণ করেছেন।
৩. তারা আল্লাহর একান্ত অনুগত ও ইবাদতগুজার-এজন্য তাদের মুহাব্বাত করা।
৪. আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে তাদের প্রিয় হওয়া। কারণ, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় বান্দাদের দৃঢ় মনোবল প্রদান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِذۡ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمۡ فَثَبِّتُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ﴾ [الانفال: ١٢]
“(ঐ মুহূর্তকে স্মরণ করুন) যখন আপনার প্রভু ফিরিশতাদের নির্দেশ করলেন আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। সুতরাং ঈমানদারদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির রাখ। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১২]
৫. সর্বাবস্থায় আল্লাহর পর্যবেক্ষণের আওতায় এবং পরিপূর্ণ সজাগ থাকা; যেন মানুষের কাছ থেকে বৈধ এবং নেক আমল ব্যতীত কোনো গুনাহ প্রকাশ না পায়। কারণ মানুষের আমলসমূহ লেখার জন্য আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত ফিরিশতা নিয়োজিত করেছেন। তারা মানুষের সকল কর্মকাণ্ড বিষয়ে অবগত হোন। তারা সর্বাবস্থায় তাদের রক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে সক্ষম।
৬. ফিরিশতাদের কষ্ট হয় এ ধরণের কাজ হতে বিরত থাকা। গুনাহের কাজ হলে তারা কষ্ট পায়। এ জন্য তারা কুকুর এবং প্রাণীর ছবি আছে এমন ঘরে প্রবেশ করে না। দুর্গন্ধ বস্তু তাদের কষ্টের উদ্রেক করে। যেমন, মসজিদে পেঁয়াজ, রসুন খাওয়া অথবা খেয়ে মসজিদে যাওয়া।

তৃতীয়ত: কিতাবসমূহের ওপর ঈমান:
কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য এমন সব কিতাব, যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য এবং যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিকূলের প্রতি রহমত ও পরকালে তাদের জন্য নাজাত ও কল্যাণস্বরূপ জিবরীলের মাধ্যমে রাসূলদের ওপর অবতীর্ণ করেছেন।
কিতাবসমূহের ওপর ঈমান আনার অর্থ:
১. এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, সকল কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে আলোকবর্তিকা, হিদায়াতের আকর হিসেবে, সত্য ধর্ম নিয়ে। 
২. বিশ্বাস করা যে এ হলো আল্লাহর কালাম বা কথা। কোনো সৃষ্টির কালাম নয়। জিবরীল আল্লাহর নিকট থেকে শ্রবণ করেছেন আর রাসূল শ্রবণ করেছেন জিবরীল থেকে।
৩. বিশ্বাস করা যে, সকল কিতাবে বর্ণিত যাবতীয় বিধি-বিধান ঐ জাতির জন্য অবশ্যই পালনীয় ছিল, যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে।
৪. বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর সকল কিতাব একটি অপরটিকে সত্যায়ন করে। পরস্পর কোনো বিরোধ নেই। তবে বিধি বিধানের ক্ষেত্রে ভিন্নতা তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষ কোনো কারণে হয়ে থাকে, যা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
৫. কিতাবসমূহ হতে যেগুলোর নাম আমারা জানি সেগুলো বিশ্বাস করা। যেমন,
• আল কুরআনুল কারীম: যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।
• তাওরাত: যা মুসা আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।
• ইঞ্জিল: যা ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।
• যাবূর: যা দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে।
• ইবরাহীম এবং মূসা আলাইহিমাস সালামের ওপর সহীফাহসমূহ। 
এছাড়া সাধারণভাবে ঐ সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করা যার নাম আমাদের জানা নেই।
৬. বিশ্বাস করা আসমানী সকল কিতাব এবং তার বিধান রহিত হয়েছে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণের মাধ্যমে। রহিত সে কিতাবগুলোর বিধান অনুসারে আমল কারো জন্য বৈধ নয়; বরং সকলের প্রতি কুরআনের অনুকরণ, অনুসরণ ফরয। এ একমাত্র কিতাব, যার কার্যকারিতা কিয়ামত অবধি অব্যাহত থাকবে। অন্য কোনো কিতাব কুরআনুল কারীমের বিধানকে রহিত করতে পারবে না।
৭. নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত অন্যান্য ঐশী গ্রন্থগুলো বাণী-বক্তব্যের সত্যতার প্রতি কুরআনের মতো-ই বিশ্বাস স্থাপন করা।
৮. এ মত পোষণ করা যে পূর্বের সকল কিতাবে পরিবর্তন-বিকৃতি ঘটেছে। কেননা যে জাতির নিকট কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল, রক্ষার দায়িত্বও তাদের হাতে দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কুরআনুল কারীম যাবতীয় বিকৃতি থেকে সুরক্ষিত। কেননা এর রক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ আপন দায়িত্বে রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: ٩]
“নিশ্চয় আমরা এ কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই তার সংরক্ষক। [সুরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
মুসলিম জীবনে আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমানের উপকারিতা:
আল্লাহ তা‘আলা তার একান্ত অনুগ্রহে পৃথিবীর তাবৎ জাতির কাছে তাদের জন্য অশেষ মঙ্গলজনক কিতাব অবতীর্ণ করেছেন -এ ব্যাপারে পূর্ণ অবগতি ও জ্ঞান লাভ করা জরুরি।
১. আমাদের এ ব্যাপারে পূর্ণ অবগতি লাভ করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা আপন প্রজ্ঞায় প্রতিটি জাতির জন্য উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন করেছেন, এ তার পূর্ণ প্রজ্ঞারই পরিচায়ক।
২. আল্লাহ যে যাবতীয় সংশয় হতে মুক্ত বিধান সম্বলিত কুরআন আমাদের নবীর ওপর অবতীর্ণ করেছেন, সে জন্য তার শোকর আদায় করা। এ কুরআন হলো কিতাবসমূহের অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী এবং এ কুরআন অন্য সকল কিতাবসমূহের প্রকৃত বিধানাবলীর রক্ষক।
৩. কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং তার তিলাওয়াত করা, অর্থ বোঝা, মুখস্থ করা, গবেষণা, বিশ্বাস, আমল এবং এ অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করা।

Faith: Foundations and Consequences (2) 
ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (২)

অনুবাদক: কামাল উদ্দীন মোল্লা 
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ঈমান : বুনিয়াদ ও পরিণতি (২)
  
চতুর্থত: নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন:
প্রথম রাসূল নূহ আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ﴾ [النساء: ١٦٣]
“আমরা আপনার প্রতি অহী পাঠিয়েছি, যেমন করে অহী পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সমস্ত নবী রাসূলের প্রতি যারা তার পরে প্রেরিত হয়েছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৩] এবং শেষ নবী ও রাসূল হলেন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। 
দলীল: আল্লাহর বাণী:
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ ﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তির পিতা নয়; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০] 
আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহর একজন নবী। আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান এবং তাঁর সাথে শির্ক থেকে মুক্ত থাকার আহ্বানের ক্ষেত্রে সকল নবী-রাসূলের আহবান ছিল অভিন্ন। প্রমাণ হিসেবে নিম্নোক্ত আয়াতটি দ্রষ্টব্য:
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]
“নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই বার্তা দিয়ে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করবে এবং তাগুতকে প্রত্যাখান করবে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬] 
তবে বিধি-বিধান এবং অবশ্যই করণীয় ফরয কাজসমূহের আহ্বানের ক্ষেত্রে সকলই একই বক্তব্যের অধিকারী ছিলেন না; বরং প্রেক্ষাপট অনুসারে তাদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন এবং অবস্থা ভেদে বিবিধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
﴿لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٤٨]
“আমরা তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৮]
নবী রাসূলগণের প্রতি ঈমানের প্রকৃতি:
রাসূলগণের প্রতি ঈমান বলতে কতিপয় বিশ্বাসকে বোঝায়:
১. বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন :
﴿وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤]
“কোনো জাতি নেই যে তার কাছে সর্তককারী প্রেরণ করা হয় নি। [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا﴾ [النحل: ٣٦]
“আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
২. নবীগণ আল্লাহর কাছ থেকে যা প্রাপ্ত হয়েছেন, তার ব্যাপারে ছিলেন পূর্ণ সত্যবাদী- এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন। তাদের সবার দীন ছিল ইসলাম। তাদের আহ্বান ছিল একত্ববাদ। তাদের যে কোনো একজনের রিসালাতকে অস্বীকার এবং মিথ্যা মনে করার অর্থ হচ্ছে সকলের রিসালাত অস্বীকার এবং সকলের প্রতি মিথ্যারোপ করা।
৩. এ অভিমত পোষণ করা যে, তারা হলেন নেককার, পরহেজগার রাসূল। আল্লাহ তাদের উত্তম চরিত্র এবং প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা সুশোভিত করেছেন। তাদের কাছে প্রেরিত অহীর সবটুকুই তারা মানুষকে অবগত করিয়েছেন। সামান্যতম গোপনতা, বৃদ্ধি ও কিংবা বিকৃতির আশ্রয় তারা নেন নি।
৪. কুরআনুল কারীমে এবং বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তাদের যে সকল নাম আমরা জানি যেমন, নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তা বিশ্বাস করা এবং যে সকল নাম আমরা অবগত নই, তাও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা।
৫. কুরআনুল কারীম এবং বিশুদ্ধ হাদীসে তাদের সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা এসেছে তা গ্রহণ করা।
৬. তাদের মধ্য হতে যাকে আমাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে তার শরীয়ত অনুসারে জীবন যাপন করা। তিনি হলেন শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
৭. বিশ্বাস করা যে, তাদের একে অপরের মর্যাদার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন উলুল আযমবৃন্দ: নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবার কতিপয়কে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। যেমন, ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ কর্তৃক তাঁর বন্ধু বলে সম্বোধন করা, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করা, ইবরাহীমের মতো তাকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা এবং মি‘রাজের রজনীতে তার সাথে কথোপকথন ইত্যাদি।
৮. বিশ্বাস করা যে, কেউ নবী হওয়া তার আপন ইচ্ছাধীন নয়; বরং আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কেউ নিজের চেষ্টায় নবী হতে পারবে না। নবুওয়াতপ্রাপ্তির ধারাবাহিকতা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের মধ্য দিয়ে শেষ এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
নবীগণের ওপর ঈমানের উকারিতা:
নবীগণের ওপর ঈমান আনয়নের অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. বান্দার ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ এবং দয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নবীদের প্রেরণ করেছেন।
২. এ মহা মূল্যবান নি‘আমতের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৩. প্রত্যেক নবী রাসূলের যোগ্যতানুযায়ী তাদের প্রশংসা, সম্মান এবং মুহাব্বত করা।
৪. আল্লাহ তা‘আলার যে কোনো আদেশ বাস্তবায়নে তাদের কায়মনোবৃত্তিতে আমাদের জন্য মহৎ শিক্ষা নিহিত রয়েছে। যেমন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক আল্লাহর আদেশে তার সন্তানকে কুরবানী করা। আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বানে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া এবং এ কাজে যে কোনো ধরনের কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষনীয়।
৫. আল্লাহর আদেশ পালনের মাধ্যমে রাসূলের মুহাব্বতের প্রকৃত বাস্তবায়নে আগ্রহী হওয়া।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب: ٢١]
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
পঞ্চমত: আখেরাতের ওপর ঈমান আনয়ন করা:
আখেরাতের ওপর ঈমানের কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১. পুনরুত্থানে বিশ্বাস: অর্থাৎ একদিন তাবৎ মৃতদের জীবিত করা হবে এবং তারা পুনরুত্থিত হবে বিশ্বপ্রতিপালকের দরবারে নগ্ন পায়ে, উলঙ্গ ও খতনাবিহীন অবস্থায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ثُمَّ إِنَّكُم بَعۡدَ ذَٰلِكَ لَمَيِّتُونَ ١٥ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ تُبۡعَثُونَ ١٦ ﴾ [المؤمنون: ١٥، ١٦]
“এরপর তোমরা অবশ্যই মারা যাবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন অবশ্যই তোমরা পুনরুত্থিত হবে। [সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১৫-১৬]
২। হিসাব এবং প্রতিদান দিবসে বিশ্বাস করা। বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ভালো-মন্দ সকল কাজের হিসাব নিবেন এবং এর জন্য বান্দা শাস্তি অথবা পুরস্কার লাভ করবে। আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨ ﴾ [الزلزلة: ٧، ٨]
“অতঃপর যে সামান্য পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে এবং যে সামান্য পরিমাণ মন্দ কাজ করবে তাও সে দেখতে পাবে।” [সূরা যিলযাল, আয়াত: ৭-৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ إِلَيۡنَآ إِيَابَهُمۡ ٢٥ ثُمَّ إِنَّ عَلَيۡنَا حِسَابَهُم ٢٦ ﴾ [الغاشية: ٢٥، ٢٦]
“নিশ্চয় তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট, অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই দায়িত্ব।” [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২৫-২৬]
৩. জান্নাত এবং জাহান্নামকে সত্য বলে জানা ও বিশ্বাস করা এবং সৃষ্টির জন্য সর্বশেষ ও চিরস্থায়ী আবাসস্থল বলে মনে করা। জান্নাত হলো সুখ, শান্তি আরামের স্থান, যা সৃষ্টি করা হয়েছে ঈমানদারদের জন্য। আর জাহান্নাম হলো দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তির স্থান, যা কাফেরদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
৪. যে সকল বিষয় মৃত্যুর পর সংঘটিত হবে বলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন সেসব বিষয়ের ওপর ঈমান আনা। যেমন, কবরে শাস্তি অথবা শান্তি, মুনকার এবং নাকীর ফেরেশতার প্রশ্ন করা, হাশরের ময়দানে সূর্যের একেবারে মাথার নিকটবর্তী হওয়া, পুলসিরাত, মিযান বা পাল্লা, আমলনামা, হাউযে কাউসার, আল্লাহর নবীর সুপারিশ- সবই আছে এবং সত্য।
আখেরাতে বিশ্বাসের সুফল:
আখেরাতে বিশ্বাসের অনেক লাভ রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. পরকালে আল্লাহর পুরষ্কার লাভের আশায় বান্দার নেক আমলে আগ্রহী হওয়া।
২. পরকালে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে বান্দার পাপাচার থেকে দূরে থাকা।
৩. পরকালে আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত সুখ, শান্তি অর্জনের আশায় ইহকালের যে আরাম-আয়েশ তার হাতছাড়া হচ্ছে তাতেও মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি লাভ করা।
ষষ্ঠ: তাকদীরের ওপর ঈমান আনয়ন করা:
তাকদীরের ওপর ঈমান: আল্লাহর রহস্যগুলোর মধ্যে একটি রহস্য হচ্ছে তাকদীর। কোনো নিকটতম ফিরিশতা অথবা প্রেরিত রাসূল পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাকদীরের ওপর ঈমানের অর্থ বান্দা এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তা‘আলা তার ইলম এবং প্রজ্ঞার দাবি অনুসারে কী হয়েছে, কী হবে, কী হচ্ছে- সব কিছু পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তাকদীরের ওপর ঈমানের স্তরসমূহ: তাকদীরে বিশ্বাসের চারটি স্তর রয়েছে:
১. আল-ইলম বা জানা: এর দ্বারা উদ্দেশ্য সৃষ্টির জন্য কোনো বস্তু সৃষ্টির পূর্বেই তার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এবং বিস্তারিত সবকিছুর সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলার অবগত হওয়া। আল্লাহ বলেন,
﴿وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“আর আল্লাহ সব বিষয় জ্ঞাত।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
২. আল-কিতাবাহ বা লিখন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য আকাশ এবং পৃথিবীসমূহ সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সব কিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রাখা। দলীল, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مِّن قَبۡلِ أَن نَّبۡرَأَهَآۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٢٢ ﴾ [الحديد: ٢٢]
“পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর এমন কোনো বিপদ আসে না, যা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। নিশ্চয় এ আল্লাহর পক্ষে সহজ।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২২]
৩. আল-মাশিয়্যাত বা ইচ্ছা: এর উদ্দেশ্য আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা-ই হয়, আর তিনি যা ইচ্ছে করেন না তা কখনোই হয় না। দলীল, আল্লাহর বাণী:
﴿وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ﴾ [القصص: ٦٨]
“আপনার প্রভু যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮]
৪. আল-খালকু বা সৃষ্টি: এর উদ্দেশ্য সারা জগত তার সকল অস্তিত্ব, রূপ এবং কর্মসহ একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি বা মাখলুক। দলীল: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَخَلَقَ كُلَّ شَيۡءٖ فَقَدَّرَهُۥ تَقۡدِيرٗا﴾ [الفرقان: ٢]
“তিনি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছেন অতঃপর নির্ধারণ করেছেন পরিমিতভাবে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২]
তাকদীরের ওপর ঈমানের ফযীলত: 
তাকদীরে বিশ্বাস দ্বারা অনেক লাভ রয়েছে। তন্মধ্যে:
১. বান্দা আল্লাহর বড়ত্ব সম্পর্কে পরিচয় লাভ করে এবং তার জ্ঞানের প্রশস্ততা, ব্যাপকতা এবং জগতে ছোট-বড় সব কিছু তার আয়ত্বে তা সম্পর্কে জানে। আরো জানে তার রাজত্বের পরিপূর্ণতা সম্পর্কে যে, তার অনুমতি ছাড়া সেখানে কোনো কিছুই সংগঠিত হয় না।
২. বান্দা তার সকল কাজে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ওপর নির্ভর করবে, কোনো বস্তুর ওপর নয়। কারণ সব কিছুই আল্লাহরই কুদরতে চলে।
৩. মানুষ কোনো কাজে সফলতা পেলে অহংকার করবে না। কারণ, এ সফলতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ওপর অনুগ্রহ মাত্র। আল্লাহই তাকে এ কাজ করার যোগ্যতা ও তাওফীক দান করেছেন। 
৪. কোনো প্রিয় বস্তুর বিরহ অথবা কোনো বিপদ দেখা দিলে অন্তরে নিশ্চয়তা ও প্রশান্তি আনয়ন। কারণ, সকল কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা এবং হুকুমে হচ্ছে।
তাকদীরে নির্ভরতার যুক্তি দেখানোর শর‘ঈ বিধান:
তাকদীরে বিশ্বাসীর ওপর অপরিহার্য যে, সে তাকদীরকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে ওয়াজিব পরিত্যাগ করা কিংবা হারাম কাজে জড়িত হবে না এবং নেক কাজে অলসতা প্রদর্শন করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর কে জাহান্নামে যাবে তা কি জানানো হয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, প্রশ্নকারী বলল, তাহলে আমলের প্রয়োজন কি? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রত্যেকের জন্য সে পথে গমন সহজতর করা হয়েছে যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম) 
যে ব্যক্তি তাকদীরকে গুনাহের কাজের বৈধতার যুক্তি হিসাবে পেশ করে, সে বলে আল্লাহ পাপ কাজ করাকে আমার নিয়তিতে লিপিবদ্ধ করেছেন, তাই আমি তা ছাড়বো কিভাবে? এই ব্যক্তির অবস্থা হল, কেউ যদি জোরপূর্বক তার সম্পত্তি নিয়ে যায় অথবা তার ইজ্জতহানী করে, সে বলে না এটা আমার নিয়তিতে ছিল, করার কিছুই নেই; বরং সে তার সম্পদ উদ্ধার এবং অপরাধীর বিচারের চেষ্টা চালিয়ে যায়। সুতরাং তাক্বদীরের দোহাই দিয়ে গুনাহ করা কীভাবে বৈধ হবে? সে যখন কোনো গুনাহ করে তখন কী করে বলবে এটা আমার তাকদীরে ছিল? অতঃপর তার গুনাহের ধারাবাহিকতা কী হিসেবে সে অব্যাহত রাখবে? বুঝার বিষয় হলো মানুষ জানে না ভবিষ্যতে কী হবে? তাহলে সে কীভাবে মনে করে যে, আল্লাহ তার নিয়তিতে গুনাহ করা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সে গুনাহ পরিত্যাগ করতে পারবে না? আল্লাহ তা‘আলা রাসূল প্রেরণ করেছেন, কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সিরাতে মুস্তাকীমের বর্ণনা দিয়েছেন, আকল-বুদ্ধি, চোখ, কান দান করেছেন এবং ভালো-মন্দ যাচাই করে চলার যোগ্যতাও আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দিয়েছেন। অতএব এ সব বলে কেউ তার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। আমাদের জানা দরকার বিবাহ ছাড়া যেমন সন্তান আসে না, খাবার ছাড়া যেমন পরিতৃপ্তি আসে না, তেমনি আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন এবং নিষেধগুলো বর্জন ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না। তাই মানুষের জন্য অবশ্যই করণীয় হলো আল্লাহ খুশি হন এমন কাজ করা, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কাজ বর্জন করে জান্নাতের অনুসন্ধান করা, আর এ জন্য আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য কামনা করা, দুর্বলতা ও অলসতা পরিহার করা। বাসনা করলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে না। কারণ, এটা আল্লাহর পণ্য। আর আল্লাহর পণ্য খুবই মূল্যবান।
হ্যাঁ, দুনিয়াতে বিপদ আপদ তো আসবেই। এটা দূর করা সম্ভব নয়। মানুষের জানা উচিত, বিপদ আপদ তাকদীরে আছে বলেই হয়। তখন বলবে “ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন”। বিপদে ধৈর্যধারণ করা, খুশি থাকা, মেনে নেওয়া পাক্কা ঈমানদারের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف، وفي كل خير، احرص على ما ينفعك واستعن بالله ولا تعجز، وإن أصابك شيء فلا تقل: لو أني فعلت كذا وكذا، ولكن قل: قدرالله وما شاء الله فعل، فإن لو تفتح عمل الشيطان». رواه مسلم 

“দুর্বল মুমিনের তূলনায় সবল মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর প্রিয়। প্রত্যেকের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। তুমি প্রচেষ্টা কর তোমার মঙ্গলের জন্য এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। অক্ষমতা প্রকাশ করো না। আর যদি তোমার কোনো বিপদ দেখা দেয় বলো না, “যদি আমি এভাবে করতাম তাহলে এরকম হতো; বরং বল: আল্লাহই আমার নিয়তিতে এটা রেখেছেন। আর আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। কারণ ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়। (সহীহ মুসলিম)
সমাপ্

Post a Comment

0 Comments