Destiny Taqdeer: A Secret of Allah God's Hidden Secret Bengali - About Islam | তাক্বদীরঃ আল্লাহ্র এক গোপন রহস্য
আব্দুল আলীম ইব্ন কাওসার
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
More Source: Islamhouse.com
Taqwadir Taqdeer: A Secret of Allah | Destiny Fate: God's Hidden Secret Bengali language about Islam ভাগ্য: আল্লাহর গোপন রহস্য | তাক্বদীরঃ আল্লাহ্র এক গোপন রহস্য:
তাক্বদীর নিয়ে আলোচনা করা কি নিষেধ?
তাক্বদীরের অর্থ
তাক্বদীরে বিশ্বাসের অপরিহার্যতাঃ
তাক্বদীরের স্তরসমূহ
প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনঃ
দ্বিতীয় স্তর: আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী লাউহে মাহ্ফূযে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে তার সবই লিখে রেখেছেন এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা
তৃতীয় স্তরঃ আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয় না একথার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস করা
চতুর্থ স্তরঃ আল্লাহ্র রাজ্যের সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন একথার প্রতি ঈমান আনা:
তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিঃ
* বিভ্রান্তির কারণঃ
* কে সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে অস্বীকার করে?
* তাক্বদীরের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত ফের্কাসমূহঃ
১. ক্বাদারিইয়াহঃ
২. জাবরিইয়াহঃ
* ক্বাদারিইয়াদের কতিপয় দলীল এবং তার জবাবঃ
* জাবরিইয়াদের কতিপয় দলীল এবং তার জবাবঃ
তাক্বদীর সম্পর্কে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাঃ
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট আল্লাহ্র ‘ইরাদাহ’ (إرادة) বা ‘ইচ্ছা’-এর পরিচয়ঃ
* ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পারস্পরিক সম্মিলন এবং বিচ্ছিন্নতার অবস্থাসমূহ
* ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পার্থক্যঃ
তাক্বদীর সম্পর্কিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাঃ
এক. আল্লাহ কর্তৃক মন্দ ও অকল্যাণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?
দুই. মন্দ কোন কিছু আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে কি?
তিন. পাপ কাজ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়ার বিধান কি?
চার. মানুষ কি বাধ্যগত জীব নাকি তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে?
পাঁচ. পথপ্রদর্শন এবং পথভ্রষ্টকরণ কি একমাত্র আল্লাহ্র হাতে?
ছয়. ঝুলন্ত (معلق) এবং অনড় (مثبت أو مبرم) তাক্বদীর প্রসঙ্গ:
সাত. তাক্বদীরের প্রতিটি সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা কি যরূরী?
তাক্বদীর কেন্দ্রিক প্রচলিত কিছু ভুল-ভ্রান্তি
১. তাক্বদীর বিরোধী কথাবার্তা বলাঃ
২. মুছীবত এলে ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করা
৩. তাক্বদীর বিরোধী কার্যকলাপ করা
৪. মৃত্যু কামনা করা
৫. আত্মহত্যা করা
৬. কণ্যা সন্তান জন্ম নিলে নারায হওয়াঃ
৭. হিংসা করা
৮. আল্লাহ্র উপর কসম করা
তাক্বদীর বিষয়ে একজন মুমিনের করণীয়ঃ
তাক্বদীর সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বাণীঃ
তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপনের কতিপয় উপকারিতাঃ
Destiny Taqdeer: A Secret of Allah God's Hidden Secret Bengali Language - About Islam | তাক্বদীরঃ আল্লাহ্র এক গোপন রহস্য
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। দরূদ এবং সালাম বর্ষিত হোক আমাদের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর।
তাক্বদীর ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। প্রকৃত মুমিন হতে হলে অবশ্যই তাক্বদীরে বিশ্বাস করতে হবে, তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন বৈ কেউ মুমিন হতে পারবে না। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাক্বদীর সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। সেজন্য ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি সরাসরি আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য যারপর নেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ আল্লাহ্র কতিপয় নাম ও গুণাবলীর সাথেই এর সরাসরি সম্পর্ক।
তাক্বদীরে বিশ্বাস মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেজন্য এমনকি জাহেলী যুগেও মানুষ এতে বিশ্বাস করত। জাহেলী অনেক কবির কবিতায় এমন বিশ্বাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কবি আনতারা তার প্রেমিকা আবলাকে লক্ষ্য করে বলেন,
يا عَبلُ أينَ من المَنيَّة ِ مَهْربي إن كانَ ربي في السَّماءِ قَضاها
‘হে আবলা! আমার প্রভূ আসমানে যদি আমার মৃত্যুর ফায়ছালা করেই রাখেন, তাহলে মৃত্যু থেকে আমার পালাবার পথ কোথায়!’
এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসে তাক্বদীরের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরেন। ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট থেকে সরাসরি দ্বীনের জ্ঞান লাভ করেন। সেজন্য তাঁরা ছিলেন তাক্বদীর উপলব্ধির ক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রগণ্য এবং এর প্রতি তাঁদের বিশ্বাসও ছিল অটুট। ফলে তাঁরা তাক্বওয়া এবং শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর যুগের শেষের দিকে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতির পর মুসলিম দেশসমূহে গ্রীক, পারসিক, ভারতীয় দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে। ফলে তাক্বদীর অস্বীকারের মত নিকৃষ্ট মতবাদের জন্ম হয়। তারপর উমাইয়া যুগে জন্ম হয় জাবরিইয়াহ মতবাদের। এসব ভ্রান্ত মতবাদের অপতৎপরতা আজও অব্যাহত রয়েছে।
মহান আল্লাহ আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে তাক্বদীরের সঠিক উপলব্ধি দান করেছেন। কারণ তারা সরাসরি পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য অনুযায়ী তাক্বদীর বুঝার চেষ্টা করেছেন। মূলতঃ তাক্বদীরসহ শরী‘আতের যেকোনো বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে এই পথেই মুক্তি নিহিত রয়েছে।
তাক্বদীরের মৌলিক বিষয়গুলি উপলব্ধি করতে পারলে একজন মুমিনের ঈমান পরিপক্ক হবে, আল্লাহ সম্পর্কে তার ধারণা সুন্দর হবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করতে পারবে। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হলে উভয় জীবনে নেমে আসবে চরম হতাশা এবং মর্মন্তুদ শাস্তি।
আমরা এ প্রবন্ধে তাক্বদীরের মৌলিক বিষয়গুলি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহই একমাত্র তাওফীক্বদাতা।
তাক্বদীর নিয়ে আলোচনা করা কি নিষেধ?
অনেকেই বলে তাক্বদীর সম্পর্কে আলোচনা করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ এ সম্পর্কে আলোচনা করলে হৃদয়ের মণিকোঠায় সন্দেহের ধূম্রজাল বাসা বাধতে পারে। তবে বিষয়টি আসলে তেমন নয়। কারণঃ
১. তাক্বদীর ঈমানের অন্যতম একটি রুকন। এর প্রতি ঈমান না আনয়ন করা পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণ হবে না। কিন্তু এ সম্পর্কে আলোচনা না করলে একজন মুসলিম তা কিভাবে বুঝবে?!
২. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীছ ‘হাদীছে জিবরীল’-এ প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে। বলা বাহুল্য যে, জিবরীল (‘আলাইহিস্সালাম) মানুষের রূপ ধরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর নিকটে হাদীছটি নিয়ে এসেছিলেন এবং ঘটনাটি ছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শেষ জীবনে। সেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন,
«فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ»
‘তিনি হচ্ছেন জিবরীল (‘আলাইহিস্সালাম)। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’। বুঝা গেল, তাক্বদীর সম্পর্কে জানা দ্বীনের অংশ; তাক্বদীরের অন্ততঃ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকা যরূরী।
৩. এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াতে তাক্বদীরের বিবরণ এসেছে। আর মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের আয়াতসমূহ গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ﴾ [سورة ص: 29]
‘এটি একটি বরকতময় কিতাব। এটিকে আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ গবেষণা করে’ (ছোয়াদ ২৯)। তাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, এ বিষয়ে আলোচনা করা ঠিক নয়?!
৪. তাক্বদীর সম্পর্কে অনেক হাদীছ এসেছে। ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে তাক্বদীরের সূক্ষ্ম বিষয়েও জিজ্ঞেস করতেন এবং তিনি তাঁদেরকে সঠিক জবাব দিতেন। অনুরূপভাবে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)ও তাঁদের ছাত্র তাবেঈনকে তাক্বদীর বিষয়ে শিক্ষা দিতেন।
৫. ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)সহ আমাদের পূর্বসূরী প্রায় সকল আলেম তাক্বদীর সম্পর্কে কথা বলেছেন, পৃথক বই-পুস্তক, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাহলে কি তাঁরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশের বিরোধিতা করেছেন? কখনই না। মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়ে যায় এবং তারা যাতে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে, সেজন্য তাদেরকে তাক্বদীর বিষয়ক হক্ব কথাটি বুঝানো কি উচিৎ নয়? এ বিষয়ে উত্থাপিত নানা প্রশ্ন এবং জটিলতার সঠিক জবাব দেওয়া কি করণীয় নয়?
৬. আমরা যদি তাক্বদীর সম্পর্কে আলোচনা করা ছেড়ে দিই, তাহলে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অজ্ঞ হয়ে যাবে। এই সুযোগে বাতিল মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং তাক্বদীর সম্পর্কে মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পথ সহজ হয়ে যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তাহলে যেসব হাদীছে তাক্বদীরের আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলির সঠিক ব্যাখ্যা কি? এক্ষণে, আমরা নীচে এজাতীয় কয়েকটি হাদীছ এবং সেগুলির সঠিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করছিঃ
১. রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«إذا ذُكِرَ أصْحابِي فأمْسِكُوا وإذا ذُكِرَتِ النُّجُومُ فأَمْسِكُوا وَإذا ذُكِرَ القَدَرُ فأمْسِكُوا»
‘আমার ছাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তারকারাজির বিধিবিধান, প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। অনুরূপভাবে তাক্বদীর সম্পর্কে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না’।
২. আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَنَحْنُ نَتَنَازَعُ فِى الْقَدَرِ فَغَضِبَ حَتَّى احْمَرَّ وَجْهُهُ حَتَّى كَأَنَّمَا فُقِئَ فِى وَجْنَتَيْهِ الرُّمَّانُ فَقَالَ: أَبِهَذَا أُمِرْتُمْ أَمْ بِهَذَا أُرْسِلْتُ إِلَيْكُمْ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حِينَ تَنَازَعُوا فِى هَذَا الأَمْرِ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَتَنَازَعُوا فِيهِ»
‘আমরা তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম, এমন সময় আমাদের নিকট রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসলেন। অতঃপর তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, রাগের প্রচণ্ডতায় তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে গেল; মনে হচ্ছিল, তাঁর কপোলদ্বয়ে ডালিম ভেঙ্গে তার রস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি এমন তর্ক-বিতর্ক করার জন্য আদিষ্ট হয়েছ নাকি আমি এ মর্মে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি! তোমাদের পূর্ববর্তীরা তো তখনই ধ্বংস হয়েছিল, যখন তারা এ বিষয়ে ঝগড়া করেছিল। তোমাদের প্রতি আামার কঠোর নির্দেশ রইলো যে, তোমরা এ নিয়ে তর্ক করবে না’।
হাদীছগুলির সঠিক ব্যাখ্যাঃ
১. হাদীছগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাক্বদীর নিয়ে বিনা দলীলে এবং বিনা জ্ঞানে অহেতুক এবং বিভ্রান্তিকর আলোচনা করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ﴾ [سورة الاسراء: 36]
‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি মাথা ঘামাইও না’ (ইসরা ৩৬)। কারণ কুরআন-হাদীছের দিকনির্দেশনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দ্বারা তাক্বদীরের সবকিছু অনুধাবন আদৌ সম্ভব নয়। অতএব, বিতর্কমূলক এবং আল্লাহ্র সিদ্ধান্তে সামান্যতম আপত্তিকর কোন আলোচনা করা যাবে না।
তবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল ভিত্তিক তাক্বদীর বুঝার উদ্দেশ্যে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাবে; বরং আলোচনা করা উচিৎ।
২. হাদীছগুলিতে তাক্বদীর নিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমনঃ কেউ একগুঁয়েমী প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ কেন অমুককে হেদায়াত করলেন, আর অমুককে পথভ্রষ্ট করলেন? এত সৃষ্টি থাকতে আল্লাহ কেন মানুষের উপর শরী‘আতের দায়িত্ব ভার অর্পণ করলেন? আল্লাহ কেন অমুককে ধনী করলেন, আর অমুককে গরীব করলেন? ইত্যাদি...সেজন্য আবূ হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী তাক্বদীর নিয়ে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর ঐদিনের আলোচনার ধরণ তুলে ধরেন এভাবে, আমরা তাক্বদীর নিয়ে বিতণ্ডা করছিলাম। আমাদের কেউ কেউ বলছিলেন, সবকিছু যদি তাক্বদীর অনুযায়ী হয়ে থাকে, তাহলে কেন বান্দাকে সুখ বা শাস্তি দেওয়া হবে? যেমনটি মু‘তাযিলারা বলে থাকে। আবার কেউ কেউ বলছিলেন, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে নির্ধারণ করার তাৎপর্য কি? এর জবাবে তাঁদের কেউ কেউ বলছিলেন, কেননা বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এর জবাবে আবার কেউ কেউ বলছিলেন, তাহলে তার সেই ইচ্ছাশক্তি কে সৃষ্টি করেছেন? আর এমন বিতণ্ডার কারণেই সেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রেগে গিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে এত্থেকে নিষেধ করেছিলেন।
তবে কেউ সত্যিকার অর্থে তাক্বদীর জানার জন্য প্রশ্ন করলে তাতে কোন দোষ নেই।
৩. ইবনে মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত উক্ত হাদীছেই আমরা আমাদের এ মতের পক্ষে বক্তব্য পাই। কেননা হাদীছটিতে বলা হয়েছে, ছাহাবায়ে করাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তার মানে কি এই যে, তাঁদের মর্যাদা-মাহাত্ম্যের কথা বলা যাবে না? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং এখানে তাঁদের মাঝে সৃষ্ট মতানৈক্য, কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাক্বদীরের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তদ্রূপই।
৪. রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসব হাদীছে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) কে তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করেছেন। কারণ তর্ক-বিতর্ক হলে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় আর মতানৈক্য সৃষ্টি হলে সেখানে অসত্য প্রবেশ করে। তবে ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের জবাব দেওয়া নিষিদ্ধ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা হক্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামের শামিল।
একটি প্রশ্ন এবং তার সমাধান: বিদ্বানগণ বলছেন, তাক্বদীর আল্লাহ্র এক গোপন রহস্য। তাহলে আমরা কিভাবে এমন একটি বিষয়ে কথা বলতে পারি? জবাবে বলব, আমরাও অকপটে স্বীকার করি, তাক্বদীর আল্লাহ্র গোপন রহস্য। কিন্তু তাক্বদীর গোপন রহস্য হওয়ার বিষয়টি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের হিকমতের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন: আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, পথ প্রদর্শন করেন, মৃত্যু ঘটান, জীবন দান করেন, কাউকে দেন আবার কাউকে মাহরূম করেন ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহ্র হিকমত জানতে চাওয়া বৈধ নয়।
হাযার চেষ্টা সত্ত্বেও তাক্বদীরের সবকিছু বুঝা সম্ভব নয়। কারণ, তাক্বদীরের জ্ঞান গায়েবী বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত; যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানেন না, তিনি যদি কাউকে না জানিয়ে থাকেন, তবে অন্যরা সেটা কিভাবে জানবে? এমনকি আল্লাহ্র নিকটতম কোন ফেরেশতা এবং নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)গণও গায়েবের কোনই খবর রাখেন না। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾ [سورة الأعراف: 188]
‘আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু আল্লাহ চান, তা ব্যতীত। আর আমি যদি গায়েবের কথা জানতাম, তাহলে অনেক কল্যাণ অর্জন করতে পারতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি ঈমানদারগণের জন্য শুধুমাত্র একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা বৈ আর কিছুই নই’ (আ‘রাফ ১৮৮)।
মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তাক্বদীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে গভীর চিন্তা করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। অতএব একজন প্রকৃত মুমিনের আল্লাহ্র বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন মুমিনকে রীতিমত সৎকর্ম করে যেতে হবে এবং অসৎকর্ম বর্জন করতে হবে।
তাক্বদীরের অর্থ
‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) বা তাক্বদীরের আভিধানিক অর্থঃ
‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) শব্দটির ‘দাল’ বর্ণে যবর দিয়ে অথবা সাকিন করে দু’ভাবেই পড়া যায়। ‘মুজমালুল্লুগাহ’ (مجمل اللغة) অভিধান প্রণেতা বলেন, ‘আল-ক্বাদ্র’ (اَلْقَدْرُ) অর্থঃ কোন কিছুর পরিধি, সীমা বা পরিমাণ। অনুরূপভাবে ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ)-এরও একই অর্থ। ‘মু‘জামু মাক্বায়ীসিল্লুগাহ’ (معجم مقاييس اللغة) প্রণেতা বলেন, ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) শব্দটি কোন কিছুর পরিধি বা শেষ সীমানা নির্দেশ করে। তিনি বলেন, আল্লাহ কর্তৃক তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছুর পরিমাণ, শেষ সীমা ইত্যাদি নির্ধারণ করার নাম ‘আল-ক্বাদ্র’ (اَلْقَدْرُ)। ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ)ও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইবনে মানযূর (রহেমাহুল্লাহ) লেহ্ইয়ানী (রহেমাহুল্লাহ) থেকে উল্লেখ করেন, যবর যোগে শব্দটি বিশেষ্য (اسم) এবং সাকিন যোগে ক্রিয়ামূল (مصدر) হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
তাক্বদীরের পারিভাষিক অর্থঃ
সবকিছু ঘটার আগেই সে সম্পর্কে আল্লাহ্র সম্যক জ্ঞান, সেগুলি লাউহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করণ, তদ্বিষয়ে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছার সমন্বয় এবং অবশেষে সেগুলিকে সৃষ্টি করাকে তাক্বদীর বলে।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের অপরিহার্যতাঃ
ঈমানের ছয়টি রুকনের মধ্যে তাক্বদীর অন্যতম। ঈমানের এ গুরুত্বপূর্ণ রুকনটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾ [سورة القمر: 49]
‘নিশ্চয় প্রত্যেকটি জিনিসকে আমরা ‘ক্বাদর’ তথা পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি (আল-ক্বামার ৪৯)। ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এই আয়াত দ্বারা তাক্বদীর সাব্যস্ত হওয়ার দলীল গ্রহণ করেন। অন্য আয়াতে এসেছে,
﴿وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَّقْدُورًا﴾ [سورة الأحزاب 38]
‘আর আল্লাহ্র বিধান সুনির্দিষ্ট, অবধারিত’ (আল-আহযাব ৩৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় অবশ্যই ঘটবে, এর সামান্যতম কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। তিনি যা চান, তা ঘটে। আর যা তিনি চান না, তা ঘটে না।
হাদীছে জিবরীলে ঈমানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,
«أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ»
‘আল্লাহ্র প্রতি, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী, আসমানী কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান’।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি,
«كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ -قَالَ- وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ»
‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে’।
ত্বাঊস (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আমি অনেকজন ছাহাবীকে পেয়েছি, যাঁরা বলতেন, সবকিছু তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়। তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে বলতে শুনেছি, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন, ‘সবকিছু তাক্বদীর মোতাবেকই ঘটে থাকে, এমনকি অপারগতা এবং বিচক্ষণতাও, অথবা বিচক্ষণতা ও অপারগতাও। অন্য এক হাদীছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন,
« لَا يُؤْمِنُ الْمَرْءُ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ »
‘তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না’।
এ ধরনের আরো বহু আয়াত এবং হাদীছ আছে, যেগুলি অকাট্যভাবে তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে।
এছাড়া মুসলিম আলেমগণ সর্বসম্মতিক্রমে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য। ইমাম নববী (রহেমাহুল্লাহ), শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ), ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ)সহ অনেকেই এই ইজমা উল্লেখ করেছেন।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ
তাক্বদীরের স্তর চারটি। মূলতঃ এই চারটি স্তরের উপর তাক্বদীরের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত বলে অনেকেই এগুলিকে তাক্বদীরের রুকন বা স্তম্ভ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
এগুলিকে আবার তাক্বদীর উপলব্ধির প্রবেশদ্বারও বলা হয়। সেজন্য প্রত্যেক মুসলিমের এ চারটি স্তর সম্পর্কে অন্ততঃ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকা অতীব যরূরী। এগুলির একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরের প্রত্যেকটি জানবে এবং বিশ্বাস করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এই চারটির কোন একটি বা একাধিক অমান্য করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরে বিশ্বাসী নয়, সে মূলতঃ তাক্বদীরকেই বিশ্বাস করে না’। নিম্নে উক্ত চারটি স্তরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ
প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনঃ
একথার অর্থ হচ্ছে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্র পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে এমর্মে আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে। যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটবে, সে সম্পর্কে তিনি জানেন। আর যা ঘটেনি, তা যদি ঘটত, তাহলে কিভাবে ঘটত, তাও তিনি জানেন। সৃষ্টির ভাল-মন্দ, আনুগত্য-অবাধ্যতা ইত্যাদি সার্বিক কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি খবর রাখেন। তাদের যাবতীয় অবস্থা, হায়াত-মউত, আয়ূস্কাল, রিযিক্ব, নড়াচড়া, স্থির থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সম্যক অবগত। তাদের মধ্যে কে দুর্ভাগা ও কে সৌভাগ্যবান হবে, বরযখী জীবনে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে, পুনরুত্থানের পরে তাদের কি হবে ইত্যাদি সব বিষয়েই তিনি চিরন্তন জ্ঞানের অধিকারী।
ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে এ বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টি জীব কি করবে, সে বিষয়ে আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে সম্যক অবগত। তিনি তাদের সৎকাজ, পাপকাজ, রিযিক্ব, আয়ূসহ সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াক্বিফহাল’।
উছমান ইবনে সাঈদ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টি জীবকে সৃষ্টির আগে থেকেই আল্লাহ তাদের সম্পর্কে ও তাদের আমল সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও জ্ঞাত থাকবেন। সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের সাথে একটি সরিষার দানা পরিমাণও যোগ হয় নি’।
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾ [سورة الأنعام: 59]
‘তাঁর কাছেই গায়েবী বিষয়ের চাবিসমূহ রয়েছে; এগুলি তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তিনিই জানেন। তাঁর জানার বাইরে (গাছের) কোন পাতাও ঝরে না। তাক্বদীরের লিখন ব্যতীত কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্যও পতিত হয় না’ (আন‘আম ৫৯)।
অন্যত্রে তিনি বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ﴾ [سورة لقمان: 34]
‘নিশ্চয় আল্লাহ্র কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (লুক্বমান ৩৪)।
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
﴿عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ﴾ [سورة المزمل: 20]
‘তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে যমীনে বিচরণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে’ (মুয্যাম্মেল ২০)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
﴿هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ﴾ [سورة الحشر: 22]
‘তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (হাশর ২২)।
হাদীছে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে যখন মুশরিকদের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তারা বেঁচে থাকলে কি আমল করত, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত’।
ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! কে জান্নাতী আর কে জাহান্নামী তা কি পরিজ্ঞাত বিষয়? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বললেন, তাহলে মানুষ কেন আমল করবে? তিনি বললেন,
«كُلٌّ يَعْمَلُ لِمَا خُلِقَ لَهُ أَوْ لِمَا يُيَسِّرُ لَهُ»
‘যাকে যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বা যার জন্য যা সহজ করা হয়েছে, সে তা-ই করবে’। এরকম অসংখ্য আয়াত এবং হাদীছ রয়েছে, যেগুলি সর্ব বিষয়ে মহান আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের প্রমাণ বহন করে।
দ্বিতীয় স্তর: আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী লাউহে মাহ্ফূযে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে তার সবই লিখে রেখেছেন এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাঃ
অর্থাৎ আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান আল্লাহ লাউহে মাহফূযে তাঁর চিরন্তন জ্ঞান মোতাবেক সৃষ্টিজগতের সবকিছুর তাক্বদীর কলম দ্বারা বাস্তবেই লিখে রেখেছেন; তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের কোন কিছুই এই লেখনী থেকে বাদ পড়ে নি। আর লাউহে মাহ্ফূযের এই লিখন ছিল আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে। তখন আল্লাহ কলম সৃষ্টি করে তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সবকিছু লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অতঃপর তিনি লাউহে মাহ্ফূযে সৃষ্টির তাক্বদীর লিখেন। সর্বপ্রথম তিনি কলম সৃষ্টি করে তাকে বলেন, লিখ। সে বলে, আমি কি লিখব? আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, তার সবই লিখ’।
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۗ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾ [سورة الحج: 70]
‘তুমি কি জান না যে, আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সব বিষয়ে আল্লাহ জানেন। এ সবকিছুই কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহ্র কাছে সহজ’ (হাজ্জ ৭০)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
﴿مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾ [سورة الحديد: 22]
‘যমীনে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর এমন কোন মুছীবত আসে না, যা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহ্র পক্ষে সহজ’ (আল-হাদীদ ২২)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে’।
ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ ছিলেন; তাঁর পূর্বে কিছুই ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে। অতঃপর আল্লাহ আসমান-যমীন সৃষ্টি করলেন এবং লাউহে মাহ্ফূযে সবকিছু লিখে রাখলেন’।
তাক্বদীর লিপিবদ্ধের পাঁচটি পর্যায়ঃ
প্রথম পর্যায়ঃ আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ লাউহে মাহ্ফূযে সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রাখেন। লাউহে মাহ্ফূযে বান্দার ভাগ্যে ভাল বা মন্দ যা-ই লিখে রাখা হয়েছে, তা-ই সে পাবে। ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছদ্বয়ে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আল্লাহ বনী আদমকে তাদের পিতা আদম (‘আলাইহিস্সালাম)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে তাদের নিকট থেকে এমর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যেন তাঁর সাথে শিরক না করে। এসময় তিনি তাদের সবাইকে দু’বার দু’মুষ্টিতে নিয়েছিলেন এবং এক মুষ্টিকে জান্নাতবাসী আর অপর মুষ্টিকে জাহান্নামবাসী হিসাবে লিখে রেখেছিলেন। এই লিখন ছিল লাউহে মাহ্ফূযে লিখনের পরের স্তরে।
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَن تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ﴾ [سورة الأعراف: 172]
‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি; যাতে ক্বিয়ামতের দিন এ কথা না বলতে পার যে, আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে বেখবর। ’ (আল-আ‘রাফ ১৭২)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ অন্ধকারে তাঁর সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে স্বীয় নূরের আলোচ্ছটা দিলেন। ঐদিন যাকে আল্লাহ্র নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করেছে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, যাকে স্পর্শ করেনি, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। সেজন্যই তো আমি বলি, কলম শুকিয়ে গেছে’।
মনে রাখতে হবে, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে লিখে দেওয়া অথবা একদলকে আল্লাহ্র নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করা এবং আরেক দলকে স্পর্শ না করার বিষয়টি এলোপাতাড়ি কোন বিষয় নয়; বরং আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞান, ইচ্ছা এবং তাঁর পরিপূর্ণ ন্যায় ও ইনছাফের উপর ভিত্তি করেই তা সংঘটিত হয়েছে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ মানুষ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আল্লাহ্র নির্দেশে ফেরেশতা এসে তার আয়ূ, কর্ম, রিযিক্ব এবং সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা, তা লিখে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
«إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِى بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ مَلَكًا ، فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ ، وَيُقَالُ لَهُ اكْتُبْ عَمَلَهُ وَرِزْقَهُ وَأَجَلَهُ وَشَقِىٌّ أَوْ سَعِيد»
‘তোমাদের যে কাউকে চল্লিশ দিন ধরে তার মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়, তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে জমাটবদ্ধ রক্ত হয় এবং তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। অতঃপর চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠান এবং তার রিযিক্ব, দুনিয়াতে তার অবস্থানকাল, তার আমলনামা এবং সে দুর্ভাগা হবে না সৌভাগ্যবান হবে তা লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়’।
লাউহে মাহ্ফূযের লিখন ছিল সমগ্র সৃষ্টিকুলের; কিন্তু মায়ের পেটের এই লিখন শুধুমাত্র মানুষ জাতির জন্য নির্দিষ্ট।
চতুর্থ পর্যায়ঃ প্রত্যেক ক্বদরের রাতে ঐ বছরের সবকিছু লেখা হয়। লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে ঐ বছরের সবকিছু লিখতে নির্দেশ দেন। ইহাকে বাৎসরিক তাক্বদীর বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ, فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ﴾[سورة الدخان: 3-4]
‘আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৩-৪)।
ইবনে আব্বাস বলেন, ক্বদরের রাতে লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী ঐ বছরের জন্ম, মৃত্যু, রিযিক্ব, বৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু আবার লেখা হয়। এমনকি ঐ বছর কে হজ্জ করবে আর কে করবে না, তাও লিখে রাখা হয়।
পঞ্চম পর্যায়ঃ পূর্বের লিখিত তাক্বদীর অনুযায়ী প্রত্যেক দিন সবকিছুকে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। ইহাকে প্রাত্যহিক তাক্বদীর বলে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ﴾ [سورة الرحمن: 29]
‘তিনি প্রতিদিন কোন না কোন কাজে রত আছেন’ (রহমান ২৯)।
ইবনে জারীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলে ছাহাবায়ে কেরাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তিনি কি করেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাউকে ক্ষমা করেন, কারো বিপদাপদ দূর করেন, কারো মর্যাদা বৃদ্ধি করেন আবার কারো মর্যাদার হানি করেন।
তাক্বদীর লিপিবদ্ধের এই পাঁচটি পর্যায়ের শেষোক্ত চারটি পর্যায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দার বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতামণ্ডলীকে তাঁদের স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা এবং এগুলি লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীরের বাইরে নয়; বরং এগুলি লাউহে মাহফূযের তাক্বদীরেরই অন্তর্ভুক্ত।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ফেরেশতামণ্ডলীকে আল্লাহ তাক্বদীরের যেসব বিষয়ে অবহিত করান, তাঁরা কেবল সেগুলিই জানেন; সেগুলির বাইরে কিছুই জানেন না। যেমন: বান্দার মৃত্যু, রিযিক্ব, সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, প্রাত্যহিক তাক্বদীর বাৎসরিক তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। বাৎসরিক তাক্বদীর মায়ের রেহেমে থাকাকালীন লিখিত তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। রেহেমে থাকাকালীন লিখিত তাক্বদীর আল্লাহ কর্তক মানুষের অঙ্গীকার নেওয়ার সময়কালীন তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। আর অঙ্গীকার নেওয়ার সময়কালীন তাক্বদীর লাউহে মাহফূযের তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ।
তৃতীয় স্তরঃ আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয় না একথার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস করাঃ
আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী তিনি সেগুলি লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন এবং সেগুলিতে তাঁর ইচ্ছাও রয়েছে। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা হয়। যা ইচ্ছা করেন না, তা হয় না। আল্লাহ্র রাজ্যে এমনকি কোন কিছুর সামান্যতম নড়াচড়া বা স্থির থাকাও তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত হয় না। তিনি কোন কিছুকে যখন, যেভাবে এবং যে উদ্দেশ্যে করতে চান, তা ঠিক সেমতেই সংঘটিত হয়; তার তিল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটে না। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, তিনি ব্যতীত কোন হক্ব মাবূদ নেই।
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ﴾ [سورة يس: 82]
‘তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, ‘হও’ এবং তখনই তা হয়ে যায় (ইয়াসীন ৮২)। অন্যত্র তিনি বলেন,
﴿وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً﴾ [سورة هود: 118]
‘আর তোমার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে একই জাতিতে পরিণত করতে পারতেন (হূদ ১১৮)। তিনি আরো বলেন,
﴿وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا﴾ [سورة يونس: 99]
‘আর তোমার প্রতিপালক যদি চাইতেন, তাহলে ভূ-পৃষ্ঠের সবাই ঈমান আনত (ইউনুস ৯৯)। এ জাতীয় আরো বহু আয়াত আছে, যেগুলি আল্লাহ্র পূর্ণ ইচ্ছা প্রমাণ করে।
আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, দো‘আ করার সময় তোমাদের কেউ যেন না বলে, হে আল্লাহ! আপনি চাইলে আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি চাইলে আমাকে রহম করুন এবং আপনি চাইলে আমাকে রিযিক্ব দান করুন। বরং সে যেন পাকাপোক্তভাবে তলব করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা খুশী, তা-ই করেন, কেউ তাঁকে বাধ্য করে না।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পৃথিবীতে আগত সকল নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-এর সর্বসম্মতি, আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যেকটি আসমানী কিতাব, আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টির স্বাভাবিক অবস্থা এবং যু্ক্তি ও প্রত্যক্ষ দর্শন প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্র রাজ্যে তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই ঘটে না। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা হয়। আর যা তিনি ইচ্ছা করেন না, তা হয় না।
চতুর্থ স্তরঃ আল্লাহ্র রাজ্যের সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন একথার প্রতি ঈমান আনা:
আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন, তাঁর চিরন্তন এই জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি সবকিছুই লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, এ সবকিছুর পেছনে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছা বিদ্যমান এবং সেই ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন। প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনি যে আকৃতিতে, যে সময়ে এবং যে বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করতে চান, সেভাবেই সৃষ্টি করেন। আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষ এবং তার কর্ম সৃষ্টি করেছেন। আসমান-যমীনে অণু-পরমাণুসহ এমন কোন কিছু নেই যে, আল্লাহ তাকে এবং তার নড়াচড়া বা স্থিরতাকে সৃষ্টি করেন নি। ঘরের জানালা বা অন্য কোন ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরে সূর্য্য কিরণ প্রবেশ করলে তাতে অসংখ্য অণু-পরমাণু পরিলক্ষিত হয়, এমনকি এসব অণু-পরমাণুর একটি কণাও আল্লাহ্র সৃষ্টির বাইরে নয়। বরং সেগুলির প্রত্যেকটি কণা সম্পর্কে আল্লাহ্র চিরন্তন সূক্ষ্ম জ্ঞান রয়েছে, তিনি তাকে লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, তাতে তাঁর ইচ্ছা রয়েছে এবং সময় মত তিনি তা সৃষ্টি করেন। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ﴾ [سورة الزمر: 62]
‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্বশীল’ (যুমার ৬২)।
বান্দার কর্মের স্রষ্টাও কি আল্লাহ নন?: বিভ্রান্ত অনেক ফের্কা বান্দার কর্মকে আল্লাহ্র সৃষ্ট নয় বলে মিথ্যা দাবী করে। কিন্তু আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা মতে, বান্দার কর্মেরও মূল স্রষ্টা মহান আল্লাহ্ই; কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়ন করে বান্দা। এরশাদ হচ্ছে,
﴿وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ﴾ [سورة الصافات: 96]
‘আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছফফাত ৯৬)। মুফাস্সিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, বান্দার কর্ম আল্লাহ্রই সৃষ্ট। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُم بَأْسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ﴾ [سورة النحل: 81]
‘আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বস্তু দ্বারা তোমাদের জন্য ছায়া বানিয়েছে। পাহাড়সমূহে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরী করেছেন এবং তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর’ (নাহ্ল ৮১)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে, তৈরীকৃত পোষাক তাঁরই তৈরী। কারণ পোষাকের কাঁচামালকে পোষাক বলা হয় না; বরং মানুষ কর্তৃক পোষাকের রূপ দেওয়া হলেই কেবল তাকে পোষাক বলা যায়। এতদ্সত্ত্বেও এটিকে সরাসরি আল্লাহ্র সৃষ্টি বলা হল’।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ يَصْنَعُ كُلَّ صَانِعٍ وَصَنْعَتَهُ»
‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহই প্রত্যেকটি তৈরীকারক এবং তার তৈরীকৃত বস্তুকে সৃষ্টি করেন’।
ইমাম বুখারী (রহেমাহুল্লাহ) এই হাদীছটি উল্লেখ করার পর বলেন, فَأَخْبَرَ أَنَّ الصِّنَاعَاتِ وَأَهْلَهَا مَخْلُوقَةٌ ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীছটিতে ঘোষণা করলেন, তৈরীকৃত সবকিছু এবং সেগুলির তৈরীকারক আল্লাহ্রই সৃষ্টি’।
আল্লাহ্র সৃষ্ট কর্ম মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন ফার্মাসিস্ট কোন ওষুধ বা বিষ বানাতে যেয়ে কয়েক প্রকার পদার্থ চয়ন করে। এরপর প্রত্যেক প্রকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থ গ্রহণ করে ওষুধ তৈরী করে। আবার দেখা যায়, ঐ একই পদার্থের পরিমাণে পরিবর্তন আনে এবং সেগুলিকে সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিষ তৈরী করে। এখানে ঔষধি এই পদার্থগুলির স্রষ্টা যেমন আল্লাহ, তেমনি ঐ ফার্মাসিস্ট, তার ক্ষমতা এবং জ্ঞানের স্রষ্টাও তিনি। বরং এই ওষুধ কিংবা বিষের স্রষ্টাও মূলতঃ আল্লাহই। অন্যভাবে বলা যায়, মহান আল্লাহ তার বান্দাকে কর্মশক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং জ্ঞান দান করেছেন। ফলে সে আল্লাহ্র সৃষ্ট পদার্থ থেকেই ভাল বা মন্দ জিনিস আবিষ্কার করছে। সে শূন্য থেকে কোন কিছু তৈরী করছে না; বরং যা করছে, আল্লাহ্র সৃষ্ট বস্তু থেকেই করছে; আর আল্লাহ্র দেয়া ক্ষমতা দিয়েই করছে।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিঃ
বিভ্রান্তির কারণঃ তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আমরা তন্মধ্যে মৌলিক কারণগুলি উল্লেখ করলামঃ
১. আল্লাহ্র কর্মকে সৃষ্টির কর্মের সাথে তুলনা করাঃ ভ্রান্ত প্রধান ফের্কাগুলি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেটি প্রশংসনীয়, আল্লাহ্র ক্ষেত্রেও ঐ একই জিনিসকে প্রশংসনীয় ভেবেছে। পক্ষান্তরে যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিন্দনীয়, সেটিকেই আল্লাহ্র ক্ষেত্রেও নিন্দনীয় মনে করেছে। যেমনঃ তারা বলেছে, মানুষের ক্ষেত্রে যা ‘ন্যায়’ হিসাবে খ্যাত, আল্লাহ্র ক্ষেত্রেও তা ‘ন্যায়’ হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে মানুষের ক্ষেত্রে যাকে ‘যুলম’ গণ্য করা হয়, তা আল্লাহ্র ক্ষেত্রেও ‘যুলম’ হিসাবেই গণ্য হবে। তাক্বদীরকে ঘিরে বিভ্রান্তির এটি অন্যতম প্রধান কারণ।
২. আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য না করা: তারা আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টিকে একই গণ্য করেছে। সুতরাং যেসব বিষয়ের প্রতি আল্লাহ শরঈভাবে সন্তুষ্ট নন, তাদের দৃষ্টিতে সেগুলিকে তিনি সৃষ্টিগতভাবেও চাননি। যেমনঃ যেহেতু আল্লাহ কুফরীসহ অন্যান্য অন্যায়-অপকর্মকে ভালবাসেন না, সেহেতু তিনি সেগুলি সৃষ্টিও করেন নি।
৩. মানুষের সংকীর্ণ বোধশক্তিকে ভাল-মন্দ নির্ণয়ের মানদণ্ড গণ্য করাঃ তাদের দৃষ্টিতে, আল্লাহ্র রাজ্যে যা কিছু হয়, সেগুলির ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করবে মানুষের আক্বল বা বোধশক্তি। সুতরাং আল্লাহ্র সৃষ্টিসমূহের মধ্যে যেগুলিকে আক্বল ভাল মনে করবে, সেগুলিই ভাল হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে আক্বল যেগুলিকে মন্দ গণ্য করবে, সেগুলি মন্দ হিসাবেই পরিগণিত হবে এবং সেগুলিকে আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত না করা যরূরী হবে।
৪. আল্লাহ্র প্রত্যেকটি কর্মের রহস্য উদঘাটনের ব্যর্থ প্রয়াস চালানোঃ তাক্বদীরের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমর্মে প্রশ্ন করা যে, ‘এটি কেন হল?’ কারণ এ জাতীয় প্রশ্ন মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়।
কে সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে অস্বীকার করে?: তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেজন্য জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামের আবির্ভাবের পরে আরবে কেউ তাক্বদীরকে অস্বীকার করত না। কিন্তু গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শনের বই-পুস্তক মুসলিম দেশসমূহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাক্বদীরকে ঘিরে ফেতনা শুরু হয়। দিমাশ্ক এবং বাছরা নগরীতে সর্বপ্রথম এই ফাসাদ শুরু হয়। মক্কা-মদীনাতে ইলমের ব্যাপক চর্চা থাকার কারণে সেখানে এমন ফেতনা প্রবেশ করতে পারে নি।
বাছরার অধিবাসী অগ্নিপূজকদের ঘরের সন্তান ‘সিসওয়াইহ্’ বা ‘সাওসান’ নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে ঘিরে বিদ‘আত সৃষ্টি করে। ইমাম আওযা‘ঈ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইরাকের অধিবাসী সাওসান নামক এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য পেশ করে। এই ব্যক্তি মূলতঃ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিল, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলেও কিছুদিন পর আবার খ্রীষ্টান ধর্মে ফিরে যায়। তার কাছ থেকে তাক্বদীর অস্বীকারের এই মন্ত্র গ্রহণ করে মা‘বাদ জুহানী এবং মা‘বাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে গায়লান’। এই দু’জনের পরে ওয়াছেল ইবনে আত্বা এবং আমর ইবনে ওবাইদ এই মতবাদের প্রচার-প্রচারণা শুরু করে।
ইমাম মুসলিম (রহেমাহুল্লাহ) ইয়াহ্ইয়া ইবনে ইয়া‘মুর (রহেমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহ্ইয়া বলেন, ‘বাছরায় মা‘বাদ জুহানী নামীয় এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর অস্বীকার করে। আমি এবং হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান হিম্ইয়ারী হজ্জ্ব বা ওমরা পালন করতে গেলাম। আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম, যদি কোন ছাহাবীর সাথে আমাদের দেখা হয়, তাহলে তাঁর কাছে তাক্বদীর অস্বীকারকারীদের বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। যাহোক, আমরা দু’জন ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে মসজিদে প্রবেশ করতে দেখে তাঁকে দু’পাশ থেকে ঘিরে দাঁড়ালাম। আমি কথা শুরু করলাম, বললাম, হে আবু আব্দির রহমান! আমাদের এলাকায় কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা কুরআন পড়ে, ইলম অর্জন করে... ইত্যাদি। কিন্তু তারা মনে করে, তাক্বদীর বলে কিছু নেই, আল্লাহ্র অজান্তেই সবকিছু এমনি এমনি হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, ‘তাদের সাথে যদি তোমাদের দেখা হয়, তাহলে বলে দিও, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কসম করে বলছে, তাদের কারো যদি উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ হয় এবং সে তা দান করে দেয়, তবুও তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আল্লাহ তার ঐ দান গ্রহণ করবেন না’। অতঃপর তিনি বললেন, আমার পিতা ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আমাকে বর্ণনা করেছেন...। এরপর তিনি হাদীছে জিবরীল নামে প্রসিদ্ধ হাদীছটি উল্লেখ করলেন।
এরপর উমাইয়া শাসনামলের শেষের দিকে জাবরিইয়াহ্দের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মতে, বান্দা ইচ্ছা শক্তিহীন বাধ্যগত জীব। জাহ্ম ইবনে ছাফওয়ান নামক এক ব্যক্তি এই ভ্রান্ত মতবাদের পুরোধা।
তাক্বদীরের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত ফের্কাসমূহঃ
তাক্বদীরকে কেন্দ্র করে অনেকগুলি দল বিভ্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে ক্বাদারিইয়াহ, জাবরিইয়াহ, ইবলীসিইয়াহ, ছূফীদের চরমপন্থী গ্রুপ, আশা‘য়েরাহ, রাফেযাহ উল্লেখযোগ্য। আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে প্রসিদ্ধতম দু’টি ফের্কা ক্বাদারিইয়াহ এবং জাবরিইয়াহ্দের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
১. ক্বাদারিইয়াহঃ এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের পুরোধা মা‘বাদ জুহানী, গায়লান দিমাশক্বী, ওয়াছেল ইবনে আত্বা প্রমুখের অনুসারী। তাদের মতে, তাক্বদীর বলতে কিছু নেই, সবকিছু এমনি এমনি হয়। তারা বলে, আল্লাহ কর্তৃক বান্দার কর্ম সৃষ্ট নয়; বরং বান্দা নিজেই নিজের কর্ম সৃষ্টি করে। বান্দার স্বতন্ত্র ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি রয়েছে, এতে আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং ক্ষমতার কোন প্রভাব পড়ে না। যে ব্যক্তি হেদায়াতপ্রাপ্ত হতে চায়, সে নিজেই নিজেকে পথ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হতে চায়, সে নিজেই নিজেকে পথভ্রষ্ট করে। ভাল-মন্দ সব ধরনের ইচ্ছার মূল নায়ক সে নিজে, এতে আল্লাহ্র কোন হাত নেই।
ক্বাদারিইয়াহদের চরমপন্থী গ্রুপের বিশ্বাস মতে, মানুষ কর্তৃক কোন কর্ম সম্পাদিত হওয়ার আগে আল্লাহ সে সম্পর্কে যেমন কোন জ্ঞান রাখেন না; তেমনি বান্দার কর্মও তিনি সৃষ্টি করেন না। তাক্বদীর অস্বীকারের এই মতবাদটিকে চরমপন্থী মতবাদ বলা হয় এবং এই মতের ধ্বজাধারীদেরকে চরমপন্থী তাক্বদীর অস্বীকারকারী (غلاة نفاة القدرية) বলা হয়।
‘বান্দার কর্ম আল্লাহ্র সৃষ্ট নয়’ এমন আক্বীদা পোষণের মাধ্যমে তারা একাধিক সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য সাব্যস্ত করেছে। কারণ বান্দা নিজেই যদি তার কর্ম সৃষ্টি করে, তাহলে আল্লাহ্র সাথে সেও দ্বিতীয় স্রষ্টা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর একারণেই তাদেরকে মাজূসী বা অগ্নিপূজকদের সাথে তুলনা করা হয়। কারণ মাজূসীরা বলে, পৃথিবীর ইলাহ দু’জন: একজন নূর বা আলোর ইলাহ এবং অপরজন অন্ধকারের ইলাহ; প্রথম জন যাবতীয় কল্যাণের স্রষ্টা এবং দ্বিতীয় জন্য যাবতীয় অকল্যাণের স্রষ্টা।
২. জাবরিইয়াহঃ এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সাংঘর্ষিক মতবাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে, মানুষ ইচ্ছা এবং কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত একটি জীব। সে তার কাজ-কর্মে জড়পদার্থ সদৃশ। সে বায়ূপ্রবাহে ভাসমান পালকের ন্যায়। গাছ-গাছালির নড়াচড়া, পানির স্রোতধারা, নক্ষত্ররাজির আবর্তন এবং সূর্যের অস্তগমণকে যেমনিভাবে রূপক অর্থে সেগুলির দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, ঠিক একইভাবে বান্দার কাজ-কর্মকেও রূপক অর্থে তার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়; প্রকৃত অর্থে নয়। যেমনঃ রূপক অর্থে বলা হয়, সূর্যোদয় হয়েছে, বাতাস প্রবাহিত হয়েছে, বৃষ্টি হয়েছে; বান্দার ক্ষেত্রেও ঠিক ঐ একই অর্থে বলা হয়, সে ছালাত আদায় করেছে, ছওম পালন করেছে, হত্যা করেছে, চুরি করেছে ইত্যাদি।
জাবরিইয়াহরা তাক্বদীর সাব্যস্ত করতে গিয়ে চরম ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছে। তারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুলমের অপবাদ দিয়েছে। এরা ক্বাদারিইয়াদের চেয়ে বেশী নিকৃষ্ট এবং ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। কারণ তাদের এই মতবাদ আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ তথা ইসলামী শরী‘আতকে অকার্যকর গণ্য করে। অনুরূপভাবে শরী‘আতের বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধের মাধ্যমে মহান আল্লাহ যে বান্দার প্রতি অতিশয় দয়া এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, সেটিকেও এই মতবাদ অস্বীকার করে।
ক্বাদারিইয়াদের কতিপয় দলীল এবং তার জবাবঃ নীচে ক্বাদারিইয়াদের প্রধান কয়েকটি দলীল এবং তার জবাব পেশ করা হল:
১. যেসব আয়াত বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রমাণ করে, সেগুলিকে তারা তাদের পক্ষের দলীল হিসাবে গ্রহণ করে। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن شَاءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاءَ فَلْيَكْفُرْ﴾ [سورة الكهف: 29]
‘অতএব, যার ইচ্ছা, সে বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা, সে অমান্য করুক’ (কাহ্ফ ২৯)। তারা বলে, এখানে আল্লাহ বান্দাকে ভাল-মন্দ যে কন একটি করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন এবং এর উপর ভিত্তি করেই তিনি তাদেরকে জান্নাত অথবা জাহান্নাম দিবেন।
জবাবঃ উক্ত আয়াত বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রমাণ করে একথা যেমন ঠিক, তেমনি আরো অনেক আয়াত আছে, যেগুলি কখনও এককভাবে আল্লাহ্র ইচ্ছা প্রমাণ করে, আবার কখনও একই সাথে বান্দা এবং আল্লাহ্র ইচ্ছা উভয়ই প্রমাণ করে। আরো প্রমাণ করে যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। কিন্তু সেগুলিকে তারা গ্রহণ করে নি। আর সে কারণেই বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রমাণকারী আয়াতসমূহকে ক্বাদারিইয়াহরা গ্রহণ করে; কিন্তু আল্লাহ্র ইচ্ছা প্রমাণকারী আয়াতসমূহকে তারা বর্জন করে। পক্ষান্তরে জাবরিইয়াহরা আল্লাহ্র ইচ্ছা প্রমাণকারী আয়াতসমূহকে তাদের পক্ষের দলীল হিসাবে গ্রহণ করে; কিন্তু বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রমাণকারী আয়াতসমূহকে তারা বর্জন করে। ফলে উভয় গ্রুপ কুরআনের আয়াতসমূহকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ উভয় গ্রুপ তার প্রতিপক্ষের বাদ দেওয়া দলীলসমূহকে নিজের পক্ষের দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং প্রতিপক্ষের গৃহীত দলীলসমূহের মস্তিষ্কপ্রসূত ও বিভ্রান্তিকর জবাব প্রদানের চেষ্টা করেছে। সেজন্য দেখা গেছে, উভয় গ্রুপ পরস্পরের দলীলের জবাব দিতে গিয়ে বড় বড় ভলিউম রচনা করেছে।
কিন্তু আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা উভয় চরম পন্থার মধ্যমপন্থী। তারা উভয় প্রকার দলীলের মধ্যে সঠিক সমন্বয় করতে সমর্থ হয়েছে। তারা বলেছে, বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি আছে, কিন্তু তা আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। আর শরঈ যেকোন বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে মধ্যমপন্থী এবং চূড়ান্ত পদ্ধতি। একটি গ্রহণ করা আরেকটি বাদ দেওয়া ন্যায় সঙ্গত কোন পদ্ধতি নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ﴾ [سورة البقرة: 85]
‘তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস করবে এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস করবে? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে, পার্থিব জীবনে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই নেই। (শুধু কি তাই!) বরং ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে নিয়ে যাওয়া হবে’ (বাক্বারাহ ৮৫)।
২. যেসব আয়াত ঘোষণা করে যে, বান্দা নিজেই ঈমান আনে, কুফরী করে, আনুগত্য করে, অবাধ্য হয়; সেগুলিকে তারা তাদের দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,
﴿كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ﴾ [سورة البقرة: 28]
‘কেমন করে তোমরা আল্লাহ্র সাথে কুফরী কর? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন’ (বাক্বারাহ ২৮)। উক্ত আয়াত এবং এজাতীয় আরো বহু আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, বান্দা নিজেই ঈমান আনে, কুফরী করে ইত্যাদি। এসব কাজ যদি প্রকৃতপক্ষে বান্দারই না হত, তবে ঈমান না আনার কারণে আল্লাহ তাকে নিন্দা এবং ভর্ৎসনা করতেন না।
জবাবঃ আমরাও স্বীকার করি, বান্দা নিজেই হয় ঈমান বেছে নেয়, না হয় কুফরী বেছে নেয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে নিজেই ঐ কুফরী বা ঈমানের স্রষ্টা; বরং আল্লাহই সেগুলির প্রকৃত স্রষ্টা আর বান্দা স্বেচ্ছায় যে কোন একটির বাস্তবায়নকারী মাত্র। সৃষ্টি এবং বাস্তবায়নের মধ্যে আকাশ-যমীন পার্থক্য রয়েছে।
৩. যেসব আয়াত ভাল-মন্দ আমলের প্রতিদান প্রমাণ করে, সেগুলিকে তারা দলীল হিসাবে পেশ করে। যেমনঃ
﴿فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾ [سورة السجدة: 17]
‘কেউ জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের কি চোখ-জুড়ানো প্রতিদান লুক্কায়িত আছে’ (সাজদাহ ১৭)। বান্দা নিজেই যদি নিজের কর্ম সৃষ্টি না করত, তাহলে কুরআন-হাদীছের এ জাতীয় বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যেত।
জবাবঃ এসব আয়াতের এমন মস্তিষ্ক প্রসূত ব্যাখ্যা করার কারণে ক্বাদারিইয়াহ এবং জাবরিইয়াহ উভয় দলই পথভ্রষ্ট হয়েছে। মনে রাখতে হবে, কুরআন-হাদীছে আমল করে জান্নাতে যাওয়া এবং না যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘হাঁ-বোধক’ এবং ‘না-বোধক’ দুই ধরনের বক্তব্য এসেছে। উল্লেখিত আয়াতটি ‘হাঁ-বোধক’ বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। ‘না-বোধক’ বক্তব্যের উদাহরণ হচ্ছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«لَنْ يَنْجُوَ أَحَدٌ مِنْكُمْ بِعَمَلِهِ «
‘তোমাদের কেউ কস্মিনকালেও তার আমলের বিনিময়ে মুক্তি পাবে না’। উক্ত আয়াত এবং এ জাতীয় অন্যান্য আয়াতের ‘বা’ (ب) বর্ণটি ‘কারণ’ (سبب) অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের আমলের কারণে জান্নাতে যাবে। আর কারণ এবং ফলাফল দু’টিই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কেননা তিনিই অনুগ্রহ করে বান্দার হেদায়াতের পথ সহজ করে দেন। সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহ্র রহমতেই জান্নাতে প্রবেশ সম্ভব।
পক্ষান্তরে উক্ত হাদীছ এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদীছের ‘বা’ বর্ণটি ‘বিনিময়’ অথবা মূল্য (عوض أو ثمن) অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ কস্মিনকালেও তোমাদের কেউ শুধুমাত্র তার আমলের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কেননা কারো আমল তার জান্নাতে প্রবেশের মূল্য স্বরূপ কখনই হবে না। বান্দা যতই আমল করুক জান্নাতের নে‘মতসমূহের তুলনায় তার আমল কিছুই নয়। বান্দা সারা জীবন যদি ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে, অন্যান্য নেকীর কাজ করে এবং যাবতীয় পাপাচার বর্জন করে চলে, তথাপিও সে আল্লাহ প্রদত্ত একটি নে‘মতের মূল্য দিতে পারবে না। তাহলে সে তার সামান্য আমলের বিনিময়ে জান্নাতের মত এত বড় নে‘মত কিভাবে ক্রয় করবে?!
কেউ কেউ বলছেন, যারা জান্নাতে যাবে, তারা আল্লাহ্র রহমতেই জান্নাতে যাবে। কিন্তু জান্নাতে জান্নাতীদের মর্যাদার কমবেশী হবে তাদের আমল অনুযায়ী। ইবনে উয়ায়নাহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাঁদের মতে, কেউ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে আল্লাহ্র ক্ষমার কারণে, জান্নাতে প্রবেশ করবে তাঁর রহমতে এবং জান্নাতে মর্যাদার কমবেশী হবে আমল অনুযায়ী’।
৪. নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) কর্তৃক তাঁদের পাপ স্বীকার সম্বলিত আয়াতসমূহঃ যেমনঃ মহান আল্লাহ আদম (‘আলাইহিস্সালাম)-এর বক্তব্য তুলে ধরে বলেন,
﴿قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا﴾ [سورة الأعراف: 23]
‘তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি যুলম করেছি’ (আ‘রাফ ২৩)। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিমুস সালাম) সম্পর্কে বলেন,
﴿قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي﴾ [سورة القصص: 16]
‘তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর যুলম করে ফেলেছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন’ (ক্বাছাছ ১৬)। ক্বাদারিইয়াহরা বলে, এ জাতীয় আয়াত প্রমাণ করে, ভাল-মন্দ কর্মের স্রষ্টা বান্দা নিজেই। আর সেকারণেই নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) তাঁদের পাপ স্বীকার করে নিয়েছেন।
জবাবঃ নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) কর্তৃক পাপ সংঘটিত হওয়ার কারণে তাঁরা তা স্বীকার করে নিয়েছেন এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সেগুলি যে আল্লাহ্র সৃষ্ট নয়, তার দলীল কোথায়?
এ জাতীয় আরো অনেক আয়াত দ্বারা ক্বাদাইরিইয়াহরা তাদের বিভ্রান্ত মতবাদ টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু সঠিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেগুলির প্রত্যেকটি তাদের বিপক্ষে।
৫. তারা যু্ক্তি পেশ করে, আল্লাহ যদি বান্দার কর্মের স্রষ্টা হতেন, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে প্রদত্ত সুখ অথবা শাস্তি দু’টিই অন্যায় প্রমাণিত হত। কারণ আল্লাহ কিভাবে কোন বান্দাকে পাপের জন্য শাস্তি দিতে পারেন, অথচ তিনিই ঐ পাপ সৃষ্টি করেছেন! আল্লাহ কখনই যুলম করতে পারেন না।
অনুরূপভাবে আল্লাহ মানুষের কর্মের স্রষ্টা হলে তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন না। বান্দা কর্তৃক ঘটিত অপরাধের জন্য তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করতেন না এবং সৎকাজের জন্য প্রশংসাও করতেন না।
জবাবঃ অকাট্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, মহান আল্লাহই বান্দার কর্মের মূল স্রষ্টা। অনুরূপভাবে অকাট্যভাবে আরো সাব্যস্ত হয়েছে যে, মানুষকে দায়িত্বভার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে এবং ইহলৌকিক জীবনের আমল মোতাবেক পারলৌকিক জীবনে ভাল বা মন্দ যে কোন একটি প্রতিদান সে পাবে। আল্লাহ তাকে শুধু দায়িত্বভার দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, কর্মশক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধি প্রদান করেছেন। সাথে সাথে নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম) প্রেরণ এবং আসমানী কিতাব অবতীর্ণের মাধ্যমে তাকে ভাল-মন্দ দু’টি পথ বাৎলে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদেরকে কোন কাজে বাধ্য করেননি এবং স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, তিনি কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলম করেন না। এরশাদ হচ্ছে,
﴿وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের প্রতি সামান্যতম যুলমকারী নন’ (আলে-ইমরান ১৮২, হজ্জ ১০, আনফাল ৫১)। অন্য আয়াতে এসেছে,
﴿وَمَا أَنَا بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾ [سورة ق: 29]
‘আমি বান্দাদের প্রতি সামান্যতম যুলমকারী নই’ (ক্বাফ ২৯)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾ [سورة فصلت: 46]
‘আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলমকারী নন’ (ফুছছিলাত ৪৬)। হাদীছে ক্বুদসীতে আল্লাহ বলেন,
«يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا»
‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের উপর যুলমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব, তোমরা পরস্পরে যুলম করো না’। সুতরাং ভাল-মন্দ উভয় আল্লাহ্র সৃষ্টি হলেও মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে যে কোন একটি বেছে নেয়। তাহলে উপরোক্ত উদ্ভট যুক্তি খাড়া করার কোন সুযোগই থাকে না এবং থাকে না আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে দায়িত্বভার প্রদান এবং বান্দার কর্ম সৃষ্টির মধ্যে কোন বৈপরীত্বও।
৬. ক্বাদারিইয়াহরা বলে, মানুষের কর্মের মধ্যে অন্যায়-অত্যাচার মিশ্রিত থাকে। সুতরাং আল্লাহ যদি বান্দার কর্মের স্রষ্টা হন, তবে তাঁর অত্যাচারী হওয়া অপরিহার্য হয়ে যাবে!
জবাবঃ আমাদেরকে ‘সৃষ্টি (خلْق) এবং সৃষ্টবস্তু (مخلوق)’-এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। এতদুভয়ের মধ্যকার পার্থক্য বুঝলে অনেক সংশয় এবং অস্পষ্টতা দূর হয়ে যাবে। এই পার্থক্য না করার কারণে ক্বাদারিইয়াহ-জাবরিইয়াহ দু’টি ফের্কাই পথভ্রষ্ট হয়েছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে আল্লাহ্র সত্ত্বাগত ছিফাত বা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সৃষ্টবস্তু আল্লাহ্র সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য নয়; বরং তা তাঁর সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং মানুষের কর্ম আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট এবং তাঁর সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সৃষ্টি নামক ক্রিয়াটি আল্লাহ্র সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ তার সৃষ্টবস্তুর মধ্যে নানা আকৃতি, গন্ধ, রং ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনিও ঐসব বিশেষণে বিশেষিত। অতএব বান্দা কর্তৃক ঘটিত অন্যায়-অত্যাচার, মিথ্যা ইত্যাদি আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট হলেও সেগুলি বান্দারই বৈশিষ্ট্য; আল্লাহ্র পবিত্র সত্ত্বা এমন বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
জাবরিইয়াদের কতিপয় দলীল এবং তার জবাবঃ নীচে জাবরিইয়াদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলীল এবং তার জবাব পেশ করা হল:
১. ‘আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা’ একথার প্রমাণ সম্বলিত আয়াতসমূহঃ যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
﴿قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ﴾ [سورة الرعد: 16]
‘বলুন, আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একক, পরাক্রমশালী’ (রা‘দ ১৬)। এ জাতীয় আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত আর কোন সৃষ্টিকারী নেই। আর বান্দার কর্ম যেহেতু আয়াতে উল্লেখিত ‘সবকিছু’-এর বাইরে নয়, সেহেতু সেটিও এককভাবে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। অতএব, বান্দার কর্মে তার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি কোনটিই নেই; বরং সে জড়পদার্থের মত এবং বাধ্যগত জীব।
জবাবঃ আমরাও তোমাদের সাথে একমত যে, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং এ জাতীয় আয়াতের বক্তব্যও ঠিক তাই। কিন্তু এসব আয়াতের কোথায় বলা হয়েছে যে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি কোনটিই নেই?! কোথায় বলা হয়েছে, বান্দার কর্ম আল্লাহ্র সৃষ্ট হলেও সে নিজে তার বাস্তবায়ন করে না?!
‘বান্দা তার কর্মের প্রকৃত বাস্তবায়নকারী নয়’ এমর্মে জাবরিইয়াহরা একটি দলীলও সাব্যস্ত করতে পারবে না। তারা সর্বোচ্চ যেটি প্রমাণ করতে পারবে, তা হল এই যে, আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা। কিন্তু এ চিরন্তন সত্য কথা তো আমরাও বিশ্বাস করি।
২. আল্লাহ্র ইচ্ছা প্রমাণকারী আয়াতসমূহ এবং ‘বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে’ এমর্মে অবতীর্ণ আয়াতসমূহঃ যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ﴾ [سورة القصص: 68]
‘আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন’ (ক্বাছাছ ৬৮)। অন্যত্র তিনি বলেন,
﴿وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 29]
‘তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারবে না’ (তাকভীর ২৯)। তিনি আরো বলেন,
﴿كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ﴾ [سورة المدثر: 31]
‘এমনিভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথপ্রদর্শন করেন’ (মুদ্দাছ্ছির ৩১)। অতএব মানুষ যেহেতু ইচ্ছা শক্তিহীন জীব এবং আল্লাহই যেহেতু তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাউকে পথ দেখান আবার কাউকে পথভ্রষ্ট করেন, সেহেতু আল্লাহই বান্দার আমলের স্রষ্টা এবং বান্দা বাধ্যগত জীব; তার কোন ইচ্ছাশক্তি নেই, নেই কোন কর্মশক্তি।
জবাবঃ ক্বাদারিইয়াদের প্রথম দলীলের জবাব দ্রষ্টব্য।
৩. যেসব আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহই হেদায়াত দান করেন এবং পথভ্রষ্ট করেন আর তাঁর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত হয়ে গেছে যে, তিনি মানব এবং জিন জাতি দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ﴾ [سورة السجدة: 13]
‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করতাম; কিন্তু আমার পক্ষ থেকে অবধারিত হয়ে গেছে যে, আমি জিন ও মানব জাতিকে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব’ (সাজদাহ ১৩)। যদি পথ প্রদর্শনের বিষয়টি আল্লাহ্র হাতেই থাকে এবং মানব ও জিন জাতিকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করার বিষয়টি যদি চূড়ান্ত হয়েই থাকে, তবে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি কোত্থেকে আসল?
অনুরূপভাবে আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ ۖ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ﴾ [سورة الأنعام: 125]
‘অতঃপর আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন, যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করে’ (আন‘আম ১২৫)। অতএব আল্লাহই হেদায়াত করতে চান অথবা বিপথগামী করতে চান। তাহলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি কোথায়?
জবাবঃ প্রথম আয়াতের অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, কে সৌভাগ্যবান হবে আর কে দুর্ভাগা হবে। অতএব উক্ত আয়াত প্রমাণ করে না যে, ভাল-মন্দ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে বাধ্য করেন।
দ্বিতীয় আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান, তিনি তার হৃদয়কে ইসলামের জন্য সহজ এবং প্রশস্ত করে দেন। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, তাওহীদ এবং ঈমান গ্রহণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দেন। পক্ষান্তরে যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান, তার হৃদয়কে তিনি সংকীর্ণ করে দেন। ফলে আল্লাহকে চেনা এবং তাঁকে ভালবাসার ক্ষেত্রে তার হৃদয়টি হয়ে যায় খুবই সংকীর্ণ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তার উপর যুলম করা হয়েছে। বরং তাকে এই শাস্তি দিয়ে আল্লাহ ইনছাফেরই পরিচয় দিয়েছেন। কেননা পথভ্রষ্ট এই ব্যক্তিটির মধ্যে আল্লাহ ঈমান গ্রহণের সার্বিক ক্ষমতা প্রদান করা সত্ত্বেও সে ঈমান গ্রহণ করেনি। বরং সে আল্লাহ্র রুবূবিইয়াত বা প্রতিপালনকে অস্বীকার করেছে, তাঁর নে‘মতসমূহের শুকরিয়া সে আদায় করেনি এবং আল্লাহ্র দাসত্বের উপরে সে শয়তানের দাসত্বকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে আল্লাহ তার হেদায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং তার বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার পথ খুলে দিয়েছেন।
অতএব এ আয়াতও কোনভাবেই বাধ্যবাধকতা প্রমাণ করে না। বরং এর সরল অর্থ হল, যে ব্যক্তি ঈমান আনে না, আল্লাহ তার হৃদয়কে সংকীর্ণ করে দেন।
৪. যেসব আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ বান্দার অন্তরে মোহর মেরে দেন। ফলে সেখানে আর ঈমান প্রবেশ করতে পারে না। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
﴿خَتَمَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ﴾ [سورة البقرة: 7]
‘আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন’ (বাক্বারাহ ৭)। তিনি আরো বলেন,
﴿بَلْ طَبَعَ اللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا﴾ [سورة النساء: 155]
‘কুফরীর কারণে স্বয়ং আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর মোহর এঁটে দিয়েছেন। ফলে তারা অতি অল্পসংখ্যক ব্যতীত কেউ ঈমান আনে না’ (নিসা ১৫৫)। অতএব স্বয়ং আল্লাহই যেহেতু বান্দার অন্তরে মোহর মেরে দেন, সেহেতু তারা বাধ্যগত জীব, তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছু নেই।
জবাবঃ এসব আয়াতের অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ বান্দা ও বান্দার ঈমান গ্রহণের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করেন, অতঃপর তাকে ঈমান আনার নির্দেশ দান করেন। বরং এসব আয়াতের মর্মার্থ হল, হক্ব জানার পরেও যেহেতু তারা তাত্থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেহেতু তাদের এই কুফরীর শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদের এবং তাদের ঈমান কবূলের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহ বারংবার তাদেরকে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন; কিন্তু তারাও বারংবার আল্লাহ্র আহ্বানের বিরোধিতা করেছে। তাহলে কেন তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন না? অতএব, এসব আয়াত কখনই জাবরিইয়াদের পক্ষের দলীল হতে পারে না।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ্র এই শাস্তি কখনও ঐ বান্দার সারা জীবনের জন্য হতে পারে। ফলে সে আর কখনও ঈমান আনার সুযোগ পায় না। আবার কখনও অস্থায়ীভাবে হতে পারে। ফলে পরবর্তীতে সে ঈমান আনার সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ কখনও কুফরীর কুফলস্বরূপ বান্দাকে অন্যান্য শাস্তিও দিতে পারেন।
৫. যেসব আয়াত বান্দা কর্তৃক কর্ম সম্পাদন সাব্যস্ত করে না; বরং আল্লাহ কর্তৃক কর্ম সম্পাদন সাব্যস্ত করে। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ رَمَىٰ﴾ [سورة الأنفال: 17]
‘আর যখন তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেছিলে, তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ’ (আনফাল ১৭)। এখানে আল্লাহ বললেন যে, তার নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেন নি; বরং স্বয়ং তিনিই নিক্ষেপ করেছিলেন। অতএব, মানুষের কোন কর্মশক্তি নেই।
জবাবঃ আয়াতটি বদর যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। এ যুদ্ধে আল্লাহ তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী দ্বারা মুসলিমদেরকে সাহায্য করেছিলেন। ফলে যুদ্ধে কাফেরদেরকে হত্যার ক্ষেত্রে মুসলিম বাহিনীর একক ভূমিকা ছিল না; বরং ফেরেশতামণ্ডলীর মাধ্যমে আল্লাহ্র সরাসরি মদদ ছিল।
দ্বিতীয়তঃ এ যুদ্ধে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক মুষ্টি মাটি কাফেরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন। এমন একজন কাফেরও ছিল না, যার দু’চোখ, মুখ এবং নাকের ছিদ্রে ঐ এক মুষ্টি মাটির অংশ আঘাত করে নি। আর সে কারণেই তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়েছিল। তাইতো মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যখন তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেছিলে, তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ’। এখানে আল্লাহ নিক্ষেপ ক্রিয়াটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য সাব্যস্ত করলেন। কিন্তু নিক্ষিপ্ত মাটি সবার চোখে-মুখে পৌঁছানোর বিষয়টি নিজের জন্য সাব্যস্ত করলেন। কারণ কাফেরদের দূরত্বে অবস্থান সত্ত্বেও স্বভাবতঃ এক মুষ্টি মাটি এতগুলি কাফেরের চোখে-মুখে এবং নাকের ছিদ্রে পৌঁছানো কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
৬. জাবরিইয়ারা বলে, আল্লাহ তাঁর চিরন্তর জ্ঞান এবং ইচ্ছার মাধ্যমে বান্দার কর্ম সৃষ্টি করেছেন এবং বান্দার কর্ম বিদ্যমান থাকার সাথে আল্লাহ্র শক্তি জড়িত। বান্দার যেকোনো কর্ম আল্লাহ্র তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়। অতএব, বান্দার নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই; বরং তারা বাধ্যগত জীব।
জবাবঃ বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র চিরন্তর জ্ঞান এবং ইচ্ছা জড়িত থাকলেও তা তাদেরকে তাদের কর্মে বাধ্য করে না। কারণ আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে বান্দার কর্ম সম্পর্কে জানেন এবং তিনি আরো জানেন যে, স্বেচ্ছায় কে কোন্টা বেছে নিবে। আর এই চিরন্তর জ্ঞান অনুপাতে তিনি তাদের কর্মও লিখে রেখেছেন। শায়খ ছালেহ আলুশ্-শায়খ বলেন, আল্লাহ তাঁর চিরন্তর জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, জাহান্নামবাসীরা স্বেচ্ছায় জাহান্নামে প্রবেশের উপযুক্ত আমল করবে। আর সে কারণেই তিনি তাদেরকে জাহান্নামবাসীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ তিনি জানেন যে, স্বেচ্ছায় কে সৎআমল করবে এবং কে অসৎ আমল করবে। আর তিনি তাঁর এই চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ীই এক দলকে জান্নাতবাসী এবং আরেক দলকে জাহান্নামবাসীর তালিকায় লিখে রেখেছেন। তিনি লিখে রেখেছেন বলেই যে তারা করতে বাধ্য তা নয়; বরং তারা স্বেচ্ছায় করবে জেনেই তিনি লিখে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ দু’জন ব্যক্তির তাক্বদীর লেখার আগেই জানতেন যে, উভয়কে একজন দ্বীনদার আলেম সৎআমল করার এবং অসৎ কাজ থেকে বেঁচে থাকার নছীহত করবেন। কিন্তু তাদের একজন স্বেচ্ছায় উক্ত আলেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৎকাজ করবে। পক্ষান্তরে অপরজন কস্মিনকালেও তার ডাকে সাড়ে দিবে না; বরং স্বেচ্ছায় পাপ কাজে সে ডুবেই থাকবে। আর সেকারণেই তিনি প্রথম জনের জন্য জান্নাত এবং অপর জনের জন্য জাহান্নাম লিখে রেখেছেন। ফলে তাদের কর্ম আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞান এবং তাক্বদীরের সাথে হুবহু মিলে গেছে।
তাহলে এখানে বান্দার ইচ্ছাশক্তি না থাকার কি রইল? অনুরূপভাবে বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র শক্তি বিদ্যমান থাকলেও তা প্রমাণ করে না যে, বান্দার কর্ম তাদের নিজস্ব কর্মশক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হয় না এবং তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মের বাস্তবায়নকারী নয়।
একদা এক ক্বাদারী এবং এক জাবরীর মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হয়। ক্বাদারী বলে, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। পক্ষান্তরে জাবরী এর বিপরীত মত প্রকাশ করে এবং বলে, বান্দা তার কর্মে বাধ্য, তার নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই। এরপর তারা একজন যোগ্য সুন্নী আলেমের কাছে বিচার নিয়ে আসে।
সুন্নী বললেন, তোমরা যার যে বক্তব্য পেশ কর। আমি সূক্ষ্মভাবে তোমাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিব। তোমাদের যার সাথে যতটুকু বাতিল রয়েছে, তা পরিত্যাগ করব এবং যতটুকু হক্ব রয়েছে, তা সাব্যস্ত করব।
ক্বাদারী বলল, আমি বলতে চাই, মহান আল্লাহ নিতান্তই ন্যায়পরায়ণ, তিনি কারো প্রতি যুলম করেন না। সুতরাং এর আলোকে আমি বান্দা কর্তৃক ঘটিত পাপকাজ আল্লাহ থেকে মুক্ত রাখতে চাই। আমি বলতে চাই, এতে আল্লাহ্র কোন ইচ্ছা নেই। বরং বান্দাই স্বতন্ত্রভাবে তা করে।
যেসব আয়াত এবং হাদীছ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি তিল পরিমাণও যুলম করেন না, সেগুলি আমার মতের পক্ষের দলীল। উল্লেখ্য যে, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতা থাকা অবস্থায় যদি আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন, তাহলে তাতে দুই দিক দিয়ে যুলম প্রমাণিত হয়:
১. বান্দার কর্ম আল্লাহ্র ইচ্ছার দিকে সম্বন্ধিত করলে তাতে যুলম সাব্যস্ত হয়।
২. আল্লাহ যেটা চেয়েছেন এবং সৃষ্টি করেছেন, তার কারণে কিভাবে তিনি বান্দাকে শাস্তি দিতে পারেন?!
এরপর যদি আমি বলি, বান্দার কর্ম আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে, তাহলে আদেশ-নিষেধ, শরী‘আত নিরর্থক হয়ে যায়। সুতরাং এমন একটি ধৃষ্টতা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমার মতের পক্ষ অবলম্বন এবং এটিই হচ্ছে ন্যায় সঙ্গত পথ।
জাবরী বলল, আমি বলতে চাই, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি যা চান, তা হয়। আর যা তিনি চান না, তা হয় না। আর যেহেতু সবকিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু বান্দার কর্মও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পরিগণিত হবে।
আমরা যদি বলি, বান্দার কর্ম আল্লাহ সৃষ্টি করেন নি বা তাতে আল্লাহ্র ইচ্ছা নেই, তবে এর অর্থ হল, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান নন এবং নন তিনি সবকিছুর স্রষ্টাও।
এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা বাধ্যগত জীব, তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছু নেই। কেননা বান্দাই যদি প্রকৃতপক্ষে তার কর্মের ইচ্ছা করত এবং বাস্তবায়ন করত, তাহলে তা আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং সৃষ্টি বহির্ভূত গণ্য হত।
যেসব আয়াত এবং হাদীছ আল্লাহ্র ইচ্ছা, সৃষ্টি এবং শক্তি প্রমাণ করে, তার সবগুলিই আমার পক্ষের দলীল।
এবার বিচারক সুন্নী বললেন, তোমাদের দু’জনই তার মতামত ব্যক্ত করেছ এবং মতামতের পক্ষে দলীল পেশ করেছ। কিন্তু সমস্যা হল, তোমাদের কেউ সর্বমুখী দলীলের প্রতি লক্ষ্য করনি; বরং একদিক গ্রহণ করেছ এবং অপরদিক বর্জন করেছ। মনে রেখ, এমন ট্যারা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে। এখন আমি তোমাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিচ্ছি:
হে ক্বাদারী! তোমার কিছু ভাল দিক রয়েছে। কারণ তুমি বলেছ, বান্দার ভাল-মন্দ কর্ম সে নিজেই করে থাকে। তোমার দলীলও ঠিক আছে। কারণ তুমি বলেছ, সেগুলি আল্লাহ বান্দার দিকে সম্বন্ধিত করেছে। তোমার আরেকটি ভাল দিক হচ্ছে: তুমি বলেছ, জাবরিইয়াহ মতবাদ ঠিক হলে শরী‘আত অনর্থক হয়ে যেত।
তবে তোমার মারাত্মক ভুলের দিকটি হল এই যে, তুমি বলেছ, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এর মাধ্যমে তুমি বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণকারী সকল দলীল অস্বীকার করেছ। মনে রেখ, প্রকৃত মুমিন সে-ই, যে বিশ্বাস করে আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও বান্দার কর্ম সে নিজেই বাস্তবায়ন করে।
হে জাবরী! তোমার ভাল দিক হচ্ছে, তুমি বলেছ, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই সবকিছুর প্রতি ক্ষমতাবান। তুমি আরো বলেছ, আল্লাহ যা চান, তা হয়। আর যা তিনি চান না, তা হয় না। তোমার পেশকৃত দলীলও সঠিক।
কিন্তু তোমার মস্ত বড় ভুল হচ্ছে, তুমি মনে করেছ, সবকিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একথার অর্থ হল, বান্দা তার কাজ-কর্মে বাধ্য, সেগুলি তার ইচ্ছায় বাস্তবায়িত হয় না।
এরপর সুন্নী আলেম বললেন, তোমরা দু’জনই একটু করে হক্ব বললেও তার সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছ। এখন এসো, আমরা দলীলের আলোকে তোমাদের ভাল-মন্দ উভয় দিক আবার একটু বিশ্লেষণ করে দেখি:
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 28-29]
‘(কুরআন ঐব্যক্তির জন্য উপদেশ) তোমাদের মধ্যে যে সোজা চলতে চায়। আর তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না (তাকভীর ২৮-২৯)। উক্ত আয়াতদ্বয় তোমাদের উভয়ের মধ্যে যথার্থ ফায়ছালা করে দিয়েছে। কেননা আয়াত দু’টি প্রমাণ করেছে যে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি রয়েছে এবং এর মাধ্যমেই সে হয় সরল পথ বেছে নেয়, না হয় বক্রপথ। আয়াতদ্বয় এটাও প্রমাণ করেছে যে, বান্দার এই ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্র ইচ্ছার বাইরে নয়, বরং তাঁর ইচ্ছার অধীনে।
কুরআন-হাদীছের বক্তব্য যেমন একথা প্রমাণ করে, তেমনি সুষ্ঠু বিবেক এবং বাস্তবতাও একথার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। কেননা আল্লাহ যেমন বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তার ইচ্ছা ও কর্মশক্তি এবং নানা বৈশিষ্ট্যের স্রষ্টাও তিনি। বিবেকবান সবাই একথা স্বীকার করবে। তোমরা দু’জন কি একথা স্বীকার কর না?!
তারা দু’জনই বলল, হ্যাঁ।
সুন্নী বললেন, আল্লাহ বান্দাকে যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি অন্যতম। আর এতদুভয়ের মাধ্যমেই সে ভাল-মন্দ সবকিছু করে থাকে। অতএব বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তির স্রষ্টাই তার কর্মেরও স্রষ্টা। অতএব সবকিছুই আল্লাহ্র সাধারণ সৃষ্টির মধ্যে গণ্য।
যদি তোমরা এই সঠিক এবং বাস্তব কথার সাথে একমত হও, তবে আমাদের মধ্যে আর দ্বন্দ্ব থাকে না। এক্ষণে তোমরা উভয়ে পরস্পরের বাতিল দিকটি পরিত্যাগ কর এবং একে অপরের ভাল দিকটি গ্রহণ কর।
‘বান্দা বাধ্যগত জীব’ এই ভ্রান্ত মতবাদ থেকে জাবরী ফিরে আসুক এবং ‘বান্দা নিজ ইচ্ছা প্রয়োগে তার কর্ম সম্পাদন করে’ এই সঠিক মতবাদ সে গ্রহণ করুক। পক্ষান্তরে ‘বান্দার কর্ম আল্লাহ্র ইচ্ছা ও সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত নয়’ এই ভ্রান্ত মতবাদ থেকে ক্বাদারী ফিরে আসুক এবং ‘সবকিছুই আল্লাহ্র সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত’ এই সঠিক মতবাদ সে গ্রহণ করুক। সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আমরা আল্লাহ্র প্রশংসা করছি।
তাক্বদীর সম্পর্কে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাঃ
ইবনু তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর মূলনীতিই হল আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক এবং মালিক। আল্লাহ্র রাজ্যে বিদ্যমান সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত; এমনকি মানুষের কর্মের স্রষ্টাও স্বয়ং আল্লাহ।
তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ যা চান, তা হয় এবং যা তিনি চান না, তা হয় না। আল্লাহ্র রাজ্যের কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা এবং শক্তি ছাড়া ঘটে না। তিনি চেয়েছেন অথচ ঘটে নি এমনটি হতে পারে না। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
তাদের বিশ্বাস মতে, যা কিছু হয়েছে এবং হবে, সবই আল্লাহ জানেন। আর যা হয় নি, তা যদি হত, তাহলে কিভাবে হত, তাও তিনি জানেন। তিনি তার সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার আগেই তাদের তাক্বদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন। সবকিছুই তিনি লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন। সবকিছুতে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছা বিদ্যমান এবং এই চিরন্তন জ্ঞান, লিখন ও ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেন। অতএব, তাঁদের আক্বীদা মতে, বিদ্যমান প্রত্যেকটি ব্যক্তি বা বস্তুতে নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছেঃ
১- আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে সেগুলি সম্পর্কে সম্যক অবগত।
২- আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে তিনি সেগুলিকে লাউহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
৩- আল্লাহ চেয়েছেন যে, সেগুলি হোক।
৪- আল্লাহ্র শক্তি, ইচ্ছা এবং সৃষ্টির মাধ্যমেই সেগুলি হয়েছে।
বান্দাকর্তৃক যা কিছু ঘটে, তার কোনটাই আল্লাহ্র ইচ্ছার বাইরে ঘটে না। তবে একথার দ্বারা তারা এটা বুঝাতে চান না যে, মানুষ ইচ্ছাশক্তিহীন জড় পদার্থ। বরং সে তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি দিয়েই স্বাধীনভাবে কাজ করে যায়। তবে তার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। এক গায়েবী পরিস্থিতির সামনে বান্দার অবস্থান, সে জানে না আল্লাহ তার জন্য কি নির্ধারণ করে রেখেছেন। সে ব্যর্থ হবে নাকি সফল হবে। কোন কিছুর চেষ্টা সত্ত্বেও সে তা পাবে কি পাবে না। কেননা মানুষের প্রচেষ্টা এবং প্রচেষ্টার ফল দেওয়া না দেওয়া উভয়ই আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। ভাগ্যের লিখন জানে না বলেই একজন মুমিন নিরলস ইবাদত-বন্দেগী করে যায়।
সেজন্য আপনি মুমিন বান্দাকে দেখবেন যে, সে তার আশা পূরণের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার আশা পূরণ হলে সে আল্লাহ্র প্রশংসা করে, আর না হলে ধৈর্য্যধারণ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিদানের প্রত্যাশী হয়। সাথে সাথে সে দৃঢ় বিশ্বাস করে, ‘তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে সঠিক কিছু করবে, তাহলে তা কখনই ভুল হতে পারে না। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে ভুল করবে, তাহলে তা কখনই সঠিক হতে পারে না’।
অনুরূপভাবে সে মনে করে না যে, তাকে কোন কাজে বাধ্য করা হয়েছে; বরং সে বারংবার বলতে থাকে, (مَا شَاءَ اللهُ كَانَ, وَمَا لَمْ يَشَأْ لَمْ يَكُنْ) ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, তা হয়েছে; তিনি যা চাননি, তা হয়নি’। সে আরো বলে, (قَدَرُ اللهُِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ) ‘এটিই হচ্ছে আল্লাহ্র তাক্বদীর এবং তিনি যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে’।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বিশ্বাস মতে, মানুষের কর্মকে তাদের নিজেদের দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, তারা নিজেরাই ঐসব কর্ম সৃষ্টি করেছে। বরং আল্লাহই সেগুলির একক স্রষ্টা। মানুষ সেগুলির সংঘটক বা বাস্তবায়নকারী মাত্র। মোদ্দাকথাঃ মানুষের কর্মের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা হিসাবে সেগুলি আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা হয়। আর মানুষ সেগুলির বাস্তবায়নকারী হিসাবে সেগুলি মানুষের দিকে সম্বন্ধিত করা হয়। আল্লাহ মানুষকে সেগুলি করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং দৈহিক শক্তি প্রদান করেছেন। সেজন্যই মানুষের কৃতকর্ম তাদের দিকেই সম্বন্ধিত করা হয় এবং ভাল কাজ করলে তারা প্রশংসিত হয় আর মন্দ কাজ করলে হয় নিন্দিত।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের এই মধ্যমপন্থী আক্বীদা কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ্র নির্যাস। তারা ক্বাদারিইয়া-জাবরিইয়াদের মত শুধুমাত্র এক পক্ষের দলীল গ্রহণ করে নি; বরং তাক্বদীর সংক্রান্ত সবগুলি দলীলের শক্ত ভিত্তির উপর তাদের আক্বীদা সুপ্রতিষ্ঠিত। অতএব, যা আল্লাহ্র কামালিয়াত বা পরিপূর্ণতার সাথে খাপ খায়, তা তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। পক্ষান্তরে যা বান্দার অবস্থার সাথে খাপ খায়, তা তার দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 28-29]
‘(কুরআন ঐব্যক্তির জন্য উপদেশ) তোমাদের মধ্যে যে সোজা চলতে চায়। তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না (তাকভীর ২৮-২৯)। উক্ত আয়াতে কারীমা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, বান্দার নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, যা তার সাথে খাপ খায়। তবে আল্লাহ্র শক্তি হচ্ছে পরিপূর্ণ। আয়াতটি আরো প্রমাণ করে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। কেননা তিনি সবকিছুর স্রষ্টা।
অনুরূপভাবে রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম)কে প্রেরণ, আসমানী কিতাবসমূহ অবতীর্ণ, শরঈ হদ্দ বা দণ্ডবিধির প্রণয়ন প্রমাণ করে যে, বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। কারণ সে যদি ইচ্ছাশক্তিহীন জড়পদার্থের মত হত, তবে এসব কোন কিছুরই প্রয়োজন পড়ত না।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট
আল্লাহ্র ‘ইরাদাহ’ (إرادة) বা ‘ইচ্ছা’-এর পরিচয়ঃ
পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায়, আল্লাহ্র ইচ্ছা দুই ধরনের: (১) ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’ (إرادة كونية) বা ‘সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছা’। (২) ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’ (إرادة شرعية) বা ‘শরঈ ইচ্ছা’।
(১) ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’ (إرادة كونية) বা সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছাঃ এই প্রকারের ইচ্ছা আল্লাহ্র রাজ্যের সবকিছুকে শামিল করে। আল্লাহ যা কিছু করতে চান, সবকিছুর সাথে এই প্রকার ইচ্ছার সম্পর্ক রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ﴾ [سورة البروج: 16]
‘তিনি যা চান, তাই করেন’ (বুরূজ ১৬)। এই প্রকার ইচ্ছা আল্লাহ্র আদেশ, ভালবাসা বা সন্তুষ্টিকে অপরিহার্য গণ্য করে না। সেজন্য এই প্রকার ইচ্ছার মাধ্যমে এমন কিছু ঘটতে পারে, যা আল্লাহ ভালবাসেন বা যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন। আবার এমন কিছুও ঘটতে পারে, যা তিনি ভালবাসেন না এবং যাতে তিনি সন্তুষ্টও হন না। যেমনঃ আল্লাহ ইবলীসকে সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু তাকে তিনি ভালবাসেন না। অপরপক্ষে তিনি মুমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাকে ভালবাসেন। অনুরূপভাবে কখনও আল্লাহ এমন কিছু সৃষ্টি করেন, যার নির্দেশ তিনি দেন না। যেমনঃ পাপীর পাপাচার। আবার কখনও তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করেন, যার নির্দেশ তিনি দেন। যেমনঃ মুমিনের আনুগত্য। এমনিভাবে কখনও আল্লাহ এমন কিছুর নির্দেশ দেন, যা তিনি সৃষ্টিই করতে চান নি। যেমনঃ আল্লাহ যাকে কোন বিষয়ে আনুগত্যের তাওফীক্ব দেন নি, তার সাথে সম্পৃক্ত আনুগত্য। আবার কখনও তিনি এমন কিছুর নির্দেশ দেন, যা সৃষ্টি করে থাকেন। যেমনঃ আল্লাহ কর্তৃক আনুগত্যের তাওফীক্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির আনুগত্য।
ইরাদাহ কাউনিইয়াহকে বাংলা ভাষায় ‘ইচ্ছা’ অর্থে ব্যবহার করা যায়। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا يَنفَعُكُمْ نُصْحِي إِنْ أَرَدتُّ أَنْ أَنصَحَ لَكُمْ إِن كَانَ اللَّهُ يُرِيدُ أَن يُغْوِيَكُمْ﴾ [سورة هود: 34]
‘আর আমি তোমাদের নছীহত করতে চাইলেও তা তোমাদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে গোমরাহ করতে চান’ (হূদ ৩৪)। এখানে ‘ইচ্ছা’-কে ভালবাসা বা সন্তুষ্টি অর্থে নেওয়া যাবে না।
(২) ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’ (إرادة شرعية) বা শরঈ ইচ্ছাঃ আল্লাহ যে বিষয়টি তাঁর বান্দা কর্তৃক বাস্তবায়িত হওয়াকে কামনা করেন এবং ভালবাসেন, এমন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ইচ্ছাকে শরঈ ইচ্ছা বলে। এই প্রকার ইচ্ছা আল্লাহ্র ভালবাসা এবং সন্তুষ্টির সাথে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। অর্থাৎ তিনি তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়টিকে ভালবাসেন, ইহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, ইহার বাস্তবায়নকারীর প্রতি খুশী হন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দান করেন। তবে তাঁর পছন্দনীয় বিষয়ের সংঘটন অপরিহার্য করে না। অবশ্য আল্লাহ্র পছন্দনীয় বিষয়টি ইরাদাহ কাউনিইয়ার সাথে সম্পর্কিত হলে তখন সেটির সংঘটন অপরিহার্য করে।
ইরাদাহ শারঈয়াহকে বাংলায় আল্লাহ্র ‘সন্তুষ্টি ও ভালবাসা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,
﴿وَاللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ﴾ [سورة النساء: 27]
‘আল্লাহ তোমাদের তওবা কবূল করতে চান’ (নিসা ২৭)। এখানে ইরাদাহ শব্দটি ভালোবাসা বা সন্তুষ্টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পারস্পরিক সম্মিলন এবং বিচ্ছিন্নতার চারটি অবস্থা। যথাঃ
প্রথম অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে উভয় প্রকার ইরাদাহ বিদ্যমান থাকে। আর মুমিন কর্তক সংঘটিত যাবতীয় সৎকর্ম এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং সকল মুমিনের ঈমান ও সৎকর্ম। উদাহরণ স্বরূপ আরো বলা যেতে পারে, কোন নেককার বান্দা ছালাত আদায় করলে তার ছালাতে উভয় প্রকার ইরাদাহ্র সমন্বয় ঘটে। কারণ ছালাত আল্লাহ্র প্রিয়, তিনি তা কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইরাদাহ শারইয়াহ। আর যেহেতু ঐ মুমিন ব্যক্তি ছালাত আদায় করে ফেলেছে, সেহেতু তা ইরাদাহ কাউনিইয়াহ। কারণ আল্লাহ্র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ না থাকলে তা কখনই ঘটত না।
অনুরূপভাবে একজন মুমিনের ঈমানে দুই প্রকার ইরাদাহ্র সমন্বয় ঘটে। কেননা মহান আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে যেমনি চেয়েছেন যে, সে অনুগত মুমিন হবে, তেমনি ধর্মীয়ভাবেও তার পক্ষ থেকে তিনি ঈমান কামনা করেছেন।
দ্বিতীয় অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে শুধুমাত্র ইরাদাহ শারঈয়াহ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ যেসব সৎকর্মের আদেশ করেছেন; কিন্তু কাফের এবং পাপী-তাপীরা আল্লাহ্র নির্দেশ লংঘন করে সেগুলি বাস্তবায়ন করে নি- এই ধরনের সৎকর্ম এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ আবু জাহ্লসহ সকল কাফেরের ঈমান এবং সৎকর্ম। অনুরূপভাবে কোন কাফেরের ঈমানে এবং পাপীর আনুগত্যে শুধুমাত্র ইরাদাহ শারঈয়াহ পাওয়া যায়। কেননা এই ঈমান এবং আনুগত্য আল্লাহ্র পছন্দ। আর পছন্দ বলেই তাতে ইরাদাহ শারঈয়াহ আছে। কিন্তু আল্লাহ্র নির্দেশ সত্ত্বেও সে যেহেতু ঈমান না এনে কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, সেহেতু তাতে (অর্থাৎ তার ঈমান আনয়নে) ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নেই। কারণ ইরাদাহ কাউনিইয়াহ থাকলে সে কাফের অবস্থায় মরত না; বরং অবশ্যই ঈমান আনত।
তৃতীয় অবস্থাঃ কোন কোন বিষয়ের সাথে শুধুমাত্র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু আদেশ করেন নি- এমন সকল পাপ কাজ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ মানুষ কর্তৃক ঘটে যাওয়া সকল পাপকর্ম। কারণ আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে না চাইলে সেগুলি ঘটত না। অনুরূপভাবে কোন কাফেরের কুফরীতে শুধুমাত্র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ মওজূদ থাকে, ইরাদাহ শারঈয়াহ নয়। কেননা যেহেতু তার পক্ষ থেকে কুফরী ঘটে গেছে, সেহেতু তা ইরাদাহ কাউনিইয়াহ। কারণ ইরাদাহ কাউনিইয়াহ না থাকলে তা কখনই ঘটত না। আর যেহেতু আল্লাহ কুফরীকে পছন্দ করেন না, সেহেতু তা ইরাদাহ শারঈয়াহ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ﴾ [سورة الزمر: 7]
‘তিনি তাঁর বান্দাদের কাফের হয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না’ (যুমার ৭)।
চতুর্থ অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে দুই প্রকার ইরাদাহ্র কোনটিরই সম্পর্ক থাকে না। যেমনঃ ঈমান অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কোন মুমিন ব্যক্তির কুফরীতে কোন প্রকার ইরাদাহ্র অস্তিত্ব থাকে না। কেননা আল্লাহ কুফরী পছন্দ করেন না। আর সেজন্যই তাতে ইরাদাহ শারঈয়াহ নেই। পক্ষান্তরে যেহেতু তা উক্ত মুমিন কর্তৃক সংঘটিত হয় নি, সেহেতু তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহও নেই। কারণ তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ থাকলে সে মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করত না; বরং কুফরী কর্ম নিয়েই দুনিয়া ছাড়ত।
ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পার্থক্যঃ
১. ইরাদাহ কাউনিইয়াহকে আল্লাহ ভালবাসতেও পারেন, নাও পারেন। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহকে তিনি অবশ্যই ভালবাসেন। সেজন্য আল্লাহ পাপ সৃষ্টি করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি পাপকে ভালবাসেন না।
২. ইরাদাহ কাউনিইয়াহর মাধ্যমে কখনও অন্য কিছুকে উদ্দেশ্য করা হয়। যেমনঃ আল্লাহ কর্তৃক ইবলীস এবং সমস্ত পাপকর্মের সৃষ্টি। প্রশ্ন হল, তাহলে এগুলি সৃষ্টির পেছনে রহস্য কি? জবাব হল, এগুলি থাকার কারণে বান্দা সবসময় সৎকর্মের জন্য মরণপণ চেষ্টা করবে, সে আল্লাহ্র নিকট তওবা করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
পক্ষান্তরে ইরাদাহ শারঈয়াহর মাধ্যমে অন্য কিছুকে উদ্দেশ্য করা হয় না; বরং সরাসরি এই ইচ্ছাই উদ্দেশ্য হয়। যেমনঃ আল্লাহ সরাসরি আনুগত্যকে ভালবাসেন এবং এর প্রতি সন্তুষ্ট হন।
৩. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নিশ্চিত বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহ বাস্তবায়িত হতেও পারে, নাও পারে। তবে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ্র সাথে এটি সম্পর্কযুক্ত হলে এটিও অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
৪. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী নয়। তবে ইহা ইরাদাহ শারঈয়াহ্র সাথে সম্পর্কযুক্ত হলে আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী হবে।
পক্ষান্তরে ইরাদাহ শারঈয়াহ আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী। সেজন্য শরঈভাবে আল্লাহ যা কিছুর ইচ্ছা করেন, তার সবগুলিকে তিনি বাস্তবায়নের নির্দেশ দান করেন।
৫. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ আল্লাহ্র রুবূবিইয়াত এবং সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহ আল্লাহ্র উলূহিইয়াত এবং শরী‘আতের সাথে সম্পর্কিত।
তাক্বদীর সম্পর্কিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাঃ
এক. আল্লাহ কর্তৃক মন্দ ও অকল্যাণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?: আমরা আগেই বলেছি, ‘আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টি-ভালবাসা’ এতদুভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যেমন: অসুস্থ ব্যক্তি ওষুধ তেতো এবং দুর্গন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই তা সেবন করে, অথচ সে এই ওষুধ সেবনে সন্তুষ্ট থাকে না। এখানে দেখা গেল, সে অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছা করে এই তেতো ওষুধ সেবন করল একটি মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে; আর তা হচ্ছে রোগমুক্তি। সেজন্য আল্লাহ কর্তৃক কোন কিছুর ইচ্ছা পোষণ এবং উহাকে সৃষ্টির অর্থ এই নয় যে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে ভালবাসেন এবং তার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।
আল্লাহ ইচ্ছা করে সৃষ্টি করেন অথচ ভালবাসেন না-এর একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষক যখন তাঁর ছাত্রদেরকে পরীক্ষা করার জন্য এমসিকিউ (MCQ) পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরী করেন, তখন চারটি অপশনের সবগুলি ইচ্ছা করে তৈরী করা সত্ত্বেও কিন্তু সবগুলিকে তিনি পছন্দ করেন না; বরং তিনি পছন্দ করেন মাত্র একটি অপশনকে। সেজন্য কোন ছাত্র শিক্ষকের পছন্দসই উত্তরটির বৃত্ত ভরাট না করলে তিনি খুশীও হন না এবং কোন নম্বরও দেন না। এই উদাহরণে দেখা গেল, শিক্ষক অপছন্দ সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ভুল অপশনগুলি রাখেন। কিন্তু সেজন্য তিনি মোটেও দোষী নন; বরং তিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ভুলভ্রান্তির সব দায়িত্ব এককভাবে ছাত্রকেই বহন করতে হয়। কেননা শিক্ষক ছাত্রকে যথারীতি পাঠদান সত্ত্বেও সে সঠিক উত্তরটি চয়ন করতে ভুল করেছে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ কর্তৃক কোন কিছু অপছন্দের অর্থ এই নয় যে, তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নেই। বরং তিনি কিছু কিছু জিনিসকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও ইচ্ছা করে তাকে সৃষ্টি করে থাকেন। এক্ষণে প্রশ্ন হল, পছন্দ করেন না, ভালবাসেন না- এমন জিনিসকে আল্লাহ কেন সৃষ্টি করেন?
জানা আবশ্যক যে, আল্লাহ্র প্রত্যেকটি কাজে হিকমত এবং কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, মানুষ সবকিছুর রহস্য জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সবকিছুর রহস্য অবগত করান না। বরং মানুষের কিছু কিছু বিষয়ের হিকমত জানা থাকলেও বেশীর ভাগই থাকে অজানা। এমনকি ফেরেশতামণ্ডলী এবং নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)গণের ক্ষেত্রেও তাই। যেমনঃ ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট মানব সৃষ্টির রহস্য গোপন ছিল এবং তাঁরা মনে করেছিলেন, এতে কোন কল্যাণ নেই। তাইতো মহান আল্লাহ সেদিন ফেরেশতামণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
﴿إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾ [سورة البقرة: 30]
‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’ (বাক্বারাহ ৩০)। অতএব কোন কিছুর রহস্য জানা থাক বা না থাক একজন মুমিনকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ্র সব কাজেই কল্যাণ এবং হিকমত রয়েছে।
এবার আমরা মূল জবাবে ফিরে আসি, অকল্যাণ কোন কিছুকে সৃষ্টির মধ্যে প্রভূত কল্যাণ এবং হিকমত নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, ঈমান আল্লাহ্র নিকট প্রিয়। কিন্তু কুফর তাঁর নিকট অপ্রিয়। অথচ অপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অনেক কল্যাণকে কেন্দ্র করে তিনি এই কুফরও সৃষ্টি করেছেন। কারণ কুফর না থাকলে ঈমান চেনা যেত না। কুফর না থাকলে আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে প্রদত্ত ঈমান নামক নে‘মতের মর্যাদা মানুষ জানতে পারত না। কুফর না থাকলে ভাল কাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধের মূলনীতি ইসলামে থাকত না। কুফর না থাকলে জিহাদ থাকত না। কুফর না থাকলে জাহান্নাম সৃষ্টি নিরর্থক হয়ে যেত। কারণ জাহান্নাম তো কাফেরদেরই আবাসস্থল। এক কথায়, কুফর এবং পাপাচার না থাকলে শরী‘আত তথা ইসলামেরই প্রয়োজন পড়ত না। আর ইসলাম না থাকলে মানুষ সৃষ্টিই অনর্থক হয়ে যেত।
অনুরূপভাবে বালা-মুছীবতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন। আল্লাহ বলেন,
﴿وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً ۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ﴾ [سورة الأنبياء: 35]
‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আম্বিয়া ৩৫)। বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহ মুমিনের অন্তঃকরণ পরিচ্ছন্ন করে দেন। কারণ বিপদাপদ, রোগ-বালাই ইত্যাদি না থাকলে মানুষ অবাধ্য, অহংকারী এবং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যেত। দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি হত। বিপদাপদের মাধ্যমে সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং সুস্থতার প্রকৃত মর্যাদা অনুধাবন করা যায়। কারণ কোন কিছুকে বুঝতে হলে তার বিপরীত জিনিস দিয়ে বুঝতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ আরো বলা যায়, যাবতীয় মন্দ কাজের মূল হোতা ইবলীস। তাহলে তাকে কেন সৃষ্টি করা হল?
জবাবে বলব, এর পেছনে আল্লাহ্র অনেক হিকমত রয়েছে। আমরা নীচে সেগুলির কয়েকটি উল্লেখ করছি:
* বিশেষত মানব এবং জিন জাতিকে পরীক্ষা করার জন্য। তাদের মধ্যে কে ভাল আর কে ভাল নয়, তা যাচাই-বাচাই করা ইবলীস সৃষ্টির অন্যতম লক্ষ্য।
* বিপরীতমুখী বিষয়গুলি সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ্র অসীম ক্ষমতা প্রকাশ। আল্লাহ যাবতীয় অকল্যাণের মূলোৎস ইবলীস নামক এই নিকৃষ্টতম সত্ত্বাটিকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি এর বিপরীতে যাবতীয় কল্যাণের মূল সর্বোচ্চ সম্মানিত ফেরেশতা জিবরীল (‘আলাইহিস্সালাম)কেও সৃষ্টি করেছেন। এতে মহান আল্লাহ্র সীমাহীন ক্ষমতাই প্রকাশ পায়। যেমনিভাবে রাত-দিন, গরম-ঠাণ্ডা, আগুন-পানি, অসুখ-সুস্থতা, হায়াত-মউত, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদি সৃষ্টিতে মহান আল্লাহ্র অপরিসীম ক্ষমতা প্রকাশ পায়। কারণ বিপরীতমুখী বিষয়গুলির অপরটি না থাকলে আল্লাহ্র হিকমত নষ্ট হয়ে যেত, তাঁর পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য স্পষ্ট হত না।
* এর মাধ্যমে আল্লাহ ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান। কারণ তারা প্রতিনিয়ত ইবলীসের সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ্র আনুগত্য এবং ইবলীস থেকে তাঁর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে তারা ইবলীসকে ক্রোধান্বিত করবে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে তার কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করবেন এবং এর মাধ্যমে তারা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রভূত কল্যাণ অর্জন করবে। কিন্তু ইবলীস না থাকলে এগুলি সম্ভব হত না।
অনুরূপভাবে আল্লাহকে ভালবাসা, তাঁর উপর ভরসা, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন, বালা-মুছীবতে ধৈর্য্যধারণ ইত্যাদি আল্লাহ্র প্রিয়তর ইবাদত; কিন্তু সেগুলি প্রবৃত্তি এবং শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া সম্ভয় নয়। ফলে ইবলীস সৃষ্টির কারণেই উক্ত ইবাদতগুলি বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
* এর মাধ্যমে আল্লাহ্র বহু নিদর্শন প্রকাশ। কারণ যালেম এবং পাপী-তাপী কর্তৃক কুফর ও মন্দ কর্ম সংঘটিত হলে আল্লাহ্র অনেক নির্দশন প্রকাশ পায়। যেমনঃ ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। এছাড়া ছামূদ জাতি এবং লূত্ব (‘আলাইহিস্সালাম)-এর ক্বওমকে সমূলে ধ্বংস, ইবরাহীম (‘আলাইহিস্সালাম)-এর জন্য আগুনের শীতল এবং শান্তিময় রূপ ধারণ, মূসা (‘আলাইহিস্সালাম)-এর হাতে সংঘটিত নানা নিদর্শনও ইবলীস সৃষ্টির মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ কর্তৃক বালা-মুছীবত সৃষ্টির উদ্দেশ্য বুঝলাম; কিন্তু আল্লাহ কেন পাপ সৃষ্টি করেছেন? জবাবে বলব, এর পেছনে অনেক রহস্য নিহিত আছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
১. আল্লাহ তওবাকারীকে ভালবাসেন। পাপ না থাকলে সেটি সম্ভব হত না।
২. আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করতে চান। তিনি পাপীকে ক্ষমা করেন, তার কৈফিয়ত শোনেন। কিন্তু পাপ না থাকলে সেটি সম্ভব হত কি?
৩. পাপ থাকার কারণে বান্দা আল্লাহ কর্তৃক তার নিজের হেফাযতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। কেননা আল্লাহ যদি তাকে পাপাচার থেকে রক্ষা না করেন, তাহলে তার বাঁচার কোন উপায় নেই, তার ধ্বংস অনিবার্য।
৪. এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ্র অনুগ্রহ, গোপনীয়তা রক্ষা, অসীম ধৈর্য্যের কথা জানতে পারে। কারণ আল্লাহ চাইলে বান্দার গোপন পাপাচার ফাঁস করে দিতে পারেন, তাকে দ্রুত শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারেন।
৫. পাপের মাধ্যমে বান্দা তওবা কবূলের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র অনুগ্রহের কথা জানতে পারে। কেননা আল্লাহই তাকে তওবা করার তাওফীক্ব দান করেছেন; অতঃপর তার তওবা কবূলও করেছেন। আল্লাহ্র ক্ষমা, অনুগ্রহ ছাড়া বান্দার মুক্তির কোন পথ নেই।
৬. পাপ থাকার কারণে বান্দা শয়তানের সাথে সার্বক্ষণিক যুদ্ধ করতে পারে এবং সে তাকে ক্রোধাণ্বিত করতে পারে। কারণ শয়তান বান্দাকে দিয়ে সর্বদা পাপ কাজ করিয়ে নিতে চায়; কিন্তু বান্দা যখন পাপ বর্জন করে চলতে পারে, তখন শয়তান রাগাণ্বিত এবং ব্যর্থ হয়ে যায়।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) এছাড়াও আরো অনেকগুলি হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন।
দুই. মন্দ কোন কিছু আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে কি?: মহান আল্লাহ নিছক মন্দ কোন কিছুই সৃষ্টি করেন না; বরং তাঁর সব কর্মই সুন্দর এবং কল্যাণকর। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন,
«وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِى يَدَيْكَ وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ»
‘(হে আল্লাহ!) যাবতীয় কল্যাণ আপনার হাতে। কিন্তু অকল্যাণ আপনার দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে না অথবা অকল্যাণ দ্বারা আপনার নৈকট্য হাছিল করা যাবে না’।
ইমাম বাগাভী (রহেমাহুল্লাহ) হাদীছের দ্বিতীয়াংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘...আল্লাহ্র মর্যাদা রক্ষার্থে পৃথকভাবে শুধু অকল্যাণ তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে না। সুতরাং বলা যাবে না, হে অকল্যাণ সৃষ্টিকারী! হে বানর এবং শূকর সৃষ্টিকারী! আপনি আমার অমুক কাজটি করে দিন, যদিও সবকিছুর সৃষ্টিকারী আল্লাহই’। আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অকল্যাণ আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, সবকিছু কি তাক্বদীর অনুযায়ী ঘটে না? জবাব হল, সবকিছু তাক্বদীর অনুযায়ীই ঘটে। তবে এখানে আল্লাহকে সম্বোধন করার আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সেজন্য হে নবীদের হত্যাকারী! হে রিযিক্ব সংকীর্ণকারী! ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে আল্লাহকে সম্বোধন করা যাবে না। বরং তাঁর আদব বজায় থাকে এমন শব্দ ব্যবহার করতে হবে’।
অতএব, নিছক অকল্যাণ বা মন্দ কোন কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেন না; বরং তাতে মহান আল্লাহ্র হিকমত রয়েছে এবং তা কারো জন্য আংশিক অকল্যাণ হলেও সাধারণ অর্থে তা কল্যাণকরই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারো উপর আল্লাহ্র দণ্ডবিধি কার্যকরকরণ ঐ ব্যক্তির জন্য কোন কোন দিক দিয়ে মন্দ হলেও অন্যদের জন্য তা কল্যাণকরই বটে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষ সতর্ক হয়, চুরি, খুন-খারাবি লোপ পায়। অনুরূপভাবে অসুস্থতা কোন কোন দিক দিয়ে খারাপ মনে হলেও মূলতঃ তাতে অনেক কল্যাণ রয়েছে।
সুতরাং মহান আল্লাহ্র সাথে আদব রক্ষার্থে নিছক মন্দ এবং অকল্যাণ তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে না। মহান আল্লাহ স্বয়ং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে এমর্মে নছীহত করেছেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿قُلْ إِن ضَلَلْتُ فَإِنَّمَا أَضِلُّ عَلَىٰ نَفْسِي ۖ وَإِنِ اهْتَدَيْتُ فَبِمَا يُوحِي إِلَيَّ رَبِّي﴾ [سورة سبأ: 50]
‘বলুন, আমি পথভ্রষ্ট হলে নিজের ক্ষতির জন্যই পথভ্রষ্ট হব। আর যদি আমি সৎপথ প্রাপ্ত হই, তবে তা আমার পালনকর্তা কর্তৃক আমার প্রতি অহি অবতীর্ণের কারণেই হয়’ (সাবা ৫০)।
তবে নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে অকল্যাণ আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা যায়ঃ
১. সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তখন অকল্যাণও এর আওতাভুক্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ﴾ [سورة الرعد: 16]
‘বলুন, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা’ (রা‘দ ১৬)।
২. কর্তা বিলুপ্ত করে বলা যেতে পারে। আল্লাহ বলেন,
﴿وَأَنَّا لَا نَدْرِي أَشَرٌّ أُرِيدَ بِمَن فِي الْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَدًا﴾ [سورة الجن: 10]
‘আমরা জানি না পৃথিবীবাসীদের অমঙ্গল সাধনের ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছে নাকি তাদের পালনকর্তা তাদের মঙ্গল সাধন করার ইচ্ছা রাখেন’ (জিন ১০)।
৩. সৃষ্টির দিকে সম্বন্ধিত করে বলা যেতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿مِن شَرِّ مَا خَلَقَ﴾ [سورة الفلق: 2]
‘তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে (আশ্রয় প্রার্থনা করছি), (ফালাক্ব ২)।
তিন. পাপ কাজ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়ার বিধান কি?: তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনার অর্থ এই নয় যে, পাপী পাপকর্ম করে অথবা ইসলামের ফরয-ওয়াজিব ছেড়ে দিয়ে তাক্বদীরের দোহাই দিবে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, কেউ পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দিতে পারে না। এ বিষয়ে সকল মুসলিম, প্রত্যেকটি ধর্মের অনুসারী এবং সকল বিবেকবান মানুষ একমত। কেননা পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া যদি বৈধ হত, তবে যে কেউ হত্যা, লুণ্ঠন, ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টির পর তাক্বদীরের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যেত। আমরা তাক্বদীরের দোহাই প্রদানকারীকে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার উপর অত্যাচার করে কেউ যদি তাক্বদীরের দোহাই দেয়, তাহলে কি তুমি তাকে ছেড়ে দিবে? সে কখনই তাকে ছেড়ে দিবে না। অতএব স্বাভাবিক এই বিবেকই প্রমাণ করে যে, পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া চলবে না।
শায়খ উছায়মীন (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, কেউ অন্যায়-অপকর্ম করে তাক্বদীরের দোহাই দিতে পারে না। কিছু কিছু অপরাধীকে তার অপরাধ প্রবণতা থেকে ফিরে আসতে বললে সে বলে, এটি আল্লাহ আমার তাক্বদীরে লিখে রেখেছেন; তুমি কি আমার প্রতি আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে চাও?! কেউ কেউ আবার আদম এবং মূসা (আলাইহিমাস সালাম)-এর ঘটনাটি দ্বারা নিজের পক্ষে দলীল গ্রহণ করতে চায়! ঘটনাটি এরূপ: আদম এবং মূসা (আলাইহিমাস সালাম)-এর মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়। তখন মূসা (‘আলাইহিস্সালাম) তাকে বলেন, আপনি আমাদের পিতা, আপনি আমাদেরকে হতাশ করে জান্নাত থেকে বের করে এনেছেন?! আদম (‘আলাইহিস্সালাম) মূসা (‘আলাইহিস্সালাম) কে বললেন, তুমি মূসা! তোমাকে আল্লাহ তার সাথে কথা বলার জন্য নির্বাচন করেছেন। তিনি তোমার জন্য নিজ হাতে তাওরাত লিখে দিয়েছেন। আমাকে সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বে আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তুমি কি সে বিষয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করছ?! নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আদম (‘আলাইহিস্সালাম) মূসা (‘আলাইহিস্সালাম)-এর উপর বিজয়ী হয়ে গেলেন’।
এই ঘটনার আলোকে সে বলে, আদম (‘আলাইহিস্সালাম) এখানে তাক্বদীরের দোহাই দিলেন এবং মূসা (‘আলাইহিস্সালাম)ও অমনি চুপ করে গেলেন, অথচ তাঁরা দুজনই নবী! তাহলে তুমি কেন আমার কাজের প্রতিবাদ করছ?
আমরা জবাবে বলব, আদম (‘আলাইহিস্সালাম) অপরাধ করেছিলেন এবং এই অপরাধের কারণে জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তওবা করেছিলেন এবং আল্লাহ তাঁর তওবা কবূলও করেছিলেন। আর তওবাকারী পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত মানুষের মত। আর একথা অসম্ভব যে, মূসা (‘আলাইহিস্সালাম)-এর মত একজন নবী তওবা করার পরও আদম (‘আলাইহিস্সালাম) কে তিরস্কার করবেন। সেজন্য তিনি ঐ অপরাধ কর্মের কারণে তাঁকে তিরস্কার করেন নি; বরং ঐ অপরাধের কারণে যে মুছীবত নেমে এসেছে, সেই মুছীবতকে তিনি তিরস্কার করেছিলেন। আর অনাঙ্খিত বিপদাপদ আসলে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া যায়; কিন্তু অপরাধ করে দেওয়া যায় না। সেজন্য মূসা (‘আলাইহিস্সালাম) বলেন নি যে, আপনি কেন আল্লাহ্র নির্দেশের খেলাপ করেছিলেন? বরং তিনি বলেছিলেন, আপনি আমাদের এবং আপনার নিজেকে কেন জান্নাত থেকে বের করেছিলেন? মহান আল্লাহ বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ﴾ [سورة التغابن: 11]
‘আল্লাহ্র নির্দেশ ব্যতিরেকে কোন বিপদ আসে না’ (তাগাবুন ১১)।
অপরাধ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়াকে পবিত্র কুরআন যেমন বিভ্রান্তিকর ঘোষণা করেছে, তেমনি সুষ্ঠু বিবেকও তা সমর্থন করে না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ ۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ حَتَّىٰ ذَاقُوا بَأْسَنَا﴾ [سورة الأنعام: 148]
‘এখন মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা শিরক করত এবং না আমরা কোন বস্তুকে হারাম করতাম। এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, এমন কি তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে’ (আন‘আম ১৪৮)।
এখানে তারা তাদের অপরাধ কর্মের পক্ষে তাক্বদীর দিয়ে দলীল পেশ করলে আল্লাহ তাদেরকে বললেন, ‘এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, এমন কি তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে’। একথা বলে আল্লাহ প্রমাণ করলেন, তাদের তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া ছিল বাতিল। কেননা এমন দোহাই দেওয়া গ্রহণযোগ্য হলে তাদেরকে আল্লাহ্র শাস্তি ভোগ করতে হত না।
কেউ যদি বলে, আল্লাহ নিজেই তো এরশাদ করেছেন,
﴿وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكُوا﴾ [سورة الأنعام: 107]
‘যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা শিরক করত না’ (আন‘আম ১০৭)। তাহলে এর জবাব কি হবে? আমরা বলব, কেউ যদি কাফের সম্পর্কে বলে, আল্লাহ চাইলে সে শিরক করত না, তাহলে তা জায়েয। তবে কোন মুশরিক যদি বলে, আল্লাহ চাইলে আমরা শিরক করতাম না, তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। উভয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর নিকট চোর তাক্বদীরের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করলে তিনি বলেছিলেন, তাক্বদীরে আছে বলেই আমিও তোমার হাত কেটে দিলাম।
এবার আসুন! আমরা যুক্তির বিচারে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি: আমরা ঐ ব্যক্তিকে বলব, পাপ কাজটি করার আগে কি তুমি জানতে যে, আল্লাহ তোমার জন্য পাপ লিখে রেখেছেন? সে বলবে, না। তখন আমরা তাকে বলব, কেন তুমি ধরে নিচ্ছ না যে, আল্লাহ তোমার জন্য পাপ নয়; বরং পূণ্যের কাজই লিখে রেখেছেন এবং সেই অনুযায়ী কেন তুমি নেকীর কাজটি করছ না? তোমার সামনে তো দু’টি দরজাই খোলা। যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে তুমি কল্যাণ প্রাপ্ত হবে, সে দরজা দিয়ে কেন তুমি প্রবেশ করতে চাইছ না?
আমরা তাকে আরো বলব, তোমাকে যদি বলা হয়, মক্কায় যাওয়ার দু’টি রাস্তা: একটি সহজ-সরল ও নিরাপদ এবং অপরটি কঠিন ও ভীতিকর; এক্ষণে তুমি কি নিরাপদ রাস্তাটি গ্রহণ করবে না? সে বলবে, অবশ্যই। তখন আমরা তাকে বলব, তাহলে ইবাদতের ক্ষেত্রে কেন তুমি নিরাপদ রাস্তাটি রেখে কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা বেছে নিচ্ছ?
আমরা তাকে আরো বলব, সরকার যদি দু’টি চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি দেন: একটি বেশী বেতনের এবং অপরটি কম বেতনের; তুমি কোন্টি বেছে নিবে? নিশ্চয় বেশী বেতলওয়ালা চাকুরীটিই তুমি বেছে নিবে। একথা প্রমাণ করে যে, তুমি বৈষয়িক জীবনে ভালটাই তালাশ করছ, কিন্তু ধর্মীয় জীবনে কেন তুমি তা করছ না?! তোমার পক্ষ থেকে একই সময়ে বিপরীতমুখী দু’টি অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন?
অতএব, তাক্বদীরের দোহাই দিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার কোনই সুযোগ নেই।
তবে পাপ করে তওবা করার পর তাক্বদীরের কথা বলা যেতে পারে। যেমনঃ যদি পাপ করার পর তওবাকারীকে কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন এই পাপ করেছ?, তাহলে সে বলতে পারে, তাক্বদীরে ছিল বলে ঘটে গেছে; কিন্তু আমি আল্লাহ্র কাছে তওবা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। আমি এমনটি আর করবো না।
অনুরূপভাবে অনাকাঙ্খিত বালা-মুছীবত এলে তখন তাক্বদীরের কথা বলা যায়। যেমনঃ দরিদ্রতা, অসুস্থতা, কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুবরণ, শস্য-ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। সুতরাং কেউ অসুস্থ হলে সে বলতে পারে, আল্লাহ্র তাক্বদীর অনুযায়ীই এই অসুখ হয়েছে। তবে তাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে।
আমরা আমাদের বক্তব্যের পক্ষে আরো কয়েকটি দলীল পেশ করছিঃ
১. মহান আল্লাহ বলেন,
﴿رُّسُلًا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا﴾ [سورة النساء: 165]
‘সুসংবাদদাতা এবং ভীতি-প্রদর্শনকারী হিসাবে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে মানুষের জন্য আল্লাহ্র প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ’ (নিসা ১৬৫)।
পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া যদি বৈধ হত, তাহলে রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) কে পাঠানোর কোন প্রয়োজনই পড়ত না।
২. পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া বৈধ হলে ইবলীসের পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করা হত। আল্লাহ ইবলীসের উক্তি তুলে ধরে বলেন,
﴿قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ﴾ [سورة الأعراف: 16]
‘সে বলল, আপনি আমাকে যেহেতু বিভ্রান্ত করেছেন, সেহেতু আমিও তাদের জন্য আপনার সরল পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো’ (আ‘রাফ ১৬)।
৩. পাপ কাজ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া জায়েয হলে ইসলামী শরী‘আতই তছনছ হয়ে যেত। আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধের কোন মূল্যই থাকত না।
৪. তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া বৈধ হলে জাহান্নামীরা দোহাই দিত। কেননা জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে; তদুপরিও তারা তাক্বদীরের দোহাই দিবে না। বরং তারা বলবে,
﴿رَبَّنَا أَخِّرْنَا إِلَىٰ أَجَلٍ قَرِيبٍ نُّجِبْ دَعْوَتَكَ وَنَتَّبِعِ الرُّسُلَ﴾ [سورة إبراهيم: 44]
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে সামান্য মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, যাতে আমরা আপনার আহবানে সাড়া দিতে পারি এবং রাসূলগণের অনুসরণ করতে পারি’ (ইবরাহীম ৪৪)। এজাতীয় আরো অনেক কথাই বলবে তারা, কিন্তু তাক্বদীরের দোহাই দিবে না।
৫. তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া যদি সিদ্ধ হত, তবে তওবা, ইস্তেগফার, দো‘আ, জিহাদ, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ ইত্যাদির কোন প্রয়োজনই পড়ত না।
৬. আমরা তাকে বলব, তুমি বিয়ে করো না। কেননা আল্লাহ তাক্বদীরে রাখলে ঠিকই সন্তান হবে। আর না রাখলে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। খানা-পিনা ছেড়ে দাও। কেননা আল্লাহ তাক্বদীরে রাখলে এমনিতেই তোমার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা মিটে যাবে, অন্যথায় কখনই তা সম্ভব নয়। তোমাকে কোন হিংস্র প্রাণী কামড়াতে আসলে তুমি পালাবে না। কারণ তাক্বদীরে থাকলে সে তোমাকে কামড়াবে অন্যথায় নয়।
সে আমাদের এসব কথায় একমত হবে? যদি একমত হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তার বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে। আর যদি সে দ্বিমত পোষণ করে, তাহলে বুঝতে হবে, সে আর তাক্বদীরের দোহাই দিচ্ছে না।
৭. পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া সিদ্ধ হলে বিশ্বব্যাপী ফেৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ত। শরী‘আতের দণ্ডবিধির কোনই প্রয়োজন পড়ত না। কোর্ট-কাচারী, বিচারক ইত্যাদির কোন দরকারই হত না।
এরকম আরো অনেক দলীল রয়েছে, যেগুলি অকাট্য প্রমাণ করে, পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
আমরা একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, যা আলোচ্য বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করবে ইনশাআল্লাহ। ঘটনাটি এরূপ: জাবরিইয়াহ মতবাদে বিশ্বাসী এক লোক যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম করে তাক্বদীরের দোহাই দিত। তার এক বন্ধু তাকে নছীহত করত; কিন্তু তা তাকে কোনই ফায়দা দিত না। তার বন্ধু তাকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
লোকটি প্রচুর সম্পদের মালিক ছিল। একেক প্রকার সম্পদ একেক জন মানুষ দেখাশুনা করত। বন্ধুর উপস্থিতিতে হঠাৎ একদিন গরু, ছাগল, উট ইত্যাদি দেখাশুনার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকটি এসে মালিককে বলল, আপনার সব পশু ক্ষুধায় মারা গেছে। কারণ যেখানে সেগুলিকে চরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে একটি ঘাসও ছিল না। মালিক বলল, জানা সত্ত্বেও তৃণ-লতাহীন ময়দানে তুমি সেগুলিকে কেন চরাতে নিয়ে গেলে? সে বলল, তাক্বদীরে ছিল বলেই এমনটি ঘটে গেছে। মালিক রাগে ফেটে পড়ল।
দেখতে দেখতে ব্যবসার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিটি এসে বলল, আপনার ব্যবসার সব মাল ডাকাতি হয়ে গেছে। কারণ ডাকাতির ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি অমুক রাস্তা দিয়েই আসছিলাম। জাবরিইয়াহ মতবাদে বিশ্বাসী মালিক বলল, জেনেশুনে কেন তুমি ভয়-ভীতিপূর্ণ রাস্তা বেছে নিলে, অথচ তোমার সামনে নিরাপদ রাস্তাও ছিল? লোকটি আগের লোকটির মত একই জবাব দিল। মালিকের রাগ আরো প্রচণ্ড আকার ধারণ করল।
এরপর তার ছেলে-মেয়ে লালন-পালনে নিয়োজিত ব্যক্তিটি এসে বলল, আমি ওদেরকে সাঁতার শিখানোর জন্য অমুক কূপে নামিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সবাই ডুবে মারা গেছে। মালিক বলল, তুমি জান যে, তারা ভাল সাঁতার জানে না এবং ঐকূপের গভীরতাও অনেক, অথচ তারপরেও তুমি একাকি কেন তাদেরকে কূপে নামিয়ে দিলে? লোকটি বলল, তাক্বদীরে থাকলে কিবা করার আছে। মালিক নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল।
এবার মালিকের বন্ধু মুখ খুলল আর বলল, তুমি খামাখা কেন এই লোকগুলির উপর রাগ করছ? কেন তুমি তাদের কৈফিয়তে খুশী থাকতে পারছ না? অথচ কত অপকর্ম করে তুমি তোমার প্রভূর সামনে এমন কৈফিয়তই পেশ করেছ?! তোমার প্রভূর সাথে তোমার কৈফিয়ত যদি গৃহীত হয়, তবে এদের কৈফিয়তও গ্রহণ করতে হবে। আর যদি তাদের কৈফিয়ত ঠাট্টার শামিল হয়, তাহলে কেন তুমি তোমার প্রভূর সাথে ঠাট্টা কর?!
তখন জাবরিইয়াহ মতবাদে বিশ্বাসী ঐ মালিকের হুঁশ ফিরল এবং বলে উঠল, আমি সেই মহান আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমাকে আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। আজকের ঘটনা থেকে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি দৃঢ় বিশ্বাস করছি এবং ঘোষণা করছি যে, আজ আমার যেসব ক্ষতি হয়েছে, সেগুলি হেদায়াতপ্রাপ্তির এই নে‘মতের তুলনায় অতি নগণ্য। যেমননিভাবে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾ [سورة البقرة: 216]
‘তোমরা এমন কিছু বিষয় অপছন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। পক্ষান্তরে তোমরা এমন কিছু পছন্দ কর, যা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না’ (বাক্বারাহ ২১৬)।
চার. মানুষ কি বাধ্যগত জীব নাকি তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে? তাক্বদীর সম্পর্কে কথা উঠলেই মানুষের মনে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়। এ প্রশ্নের জবাবে আলেমগণ বলেন, মানুষ কিছু কিছু বিষয়ে বাধ্যগত এবং কিছু কিছু বিষয়ে তার নিজস্ব ইচ্ছা শক্তি রয়েছে। যেসব বিষয়ে আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দেন নি, সেসব ক্ষেত্রে মানুষ বাধ্য। যেমনঃ অসুস্থতা, জন্ম, মৃত্যু, নানা রকম দুর্ঘটনা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মানুষের চুল, নখ ইত্যাদির প্রবৃদ্ধিও ঘটে তার ইচ্ছার বাইরে। পক্ষান্তরে যেসব কাজ সে তার নিজস্ব ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে করতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে সে স্বাধীন। তবে তার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত বাস্তবায়িত হয় না। যেমনঃ উঠা, বসা, শোয়া, হাঁটা, কোথাও প্রবেশ করা, বের হওয়া, ভাল কাজ করা, পাপ কাজ করা ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুমি যখন তোমার বন্ধু-বান্ধবের সাথে কোথাও আনন্দ ভ্রমণে যাওয়ার ইচ্ছা কর, তখন সবচেয়ে সুন্দর এবং মনোরম স্থান চয়নের জন্য তুমি তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর পরামর্শের ভিত্তিতে সবচেয়ে উত্তম জায়গাটি চয়ন কর। তুমি যদি বাধ্যগত জীব হতে, তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ স্থানে চলে যেতে; বন্ধুদের সাথে তোমার পরামর্শের যেমন কোন প্রয়োজন পড়ত না, তেমনি স্থান চয়নেরও দরকার হত না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, তবে তা আল্লাহ্র তাক্বদীরের বাইরে নয়, এটি কিভাবে সম্ভব? আমরা তাকে বলব, বান্দা কর্তৃক সংঘটিত যে কোন কর্ম বান্দা কিসের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে? এক বাক্যে সবাই বলবে, ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সে তা বাস্তবায়ন করে। আমরা তাকে আবার প্রশ্ন করি, ঐ ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তির স্রষ্টা কে? সবাই স্বীকার করবে, আল্লাহই সেগুলির সৃষ্টিকর্তা। তাহলে দেখা গেল, বান্দার কর্ম এবং উক্ত কর্ম বাস্তবায়নের উপকরণ ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি সবই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এতটুকু জানলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
শায়খ উছায়মীন (রহেমাহুল্লাহ)কে মানুষ বাধ্য কিনা এই প্রশ্ন করা হলে জবাব দেওয়ার আগেই তিনি বলেন, প্রশ্নকারী নিজেকে জিজ্ঞেস করুক, এই প্রশ্নটি করতে কেউ কি তাকে বাধ্য করেছে? তার যে মডেলের গাড়ী আছে, ঐ মডেলের গাড়ী কিনতে কেউ কি তাকে বাধ্য করেছে? এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে প্রশ্নকারী তার কাঙ্খিত উত্তরটি পেয়ে যাবে।
সে নিজেকে আরো জিজ্ঞস করুক, সে কি স্বেচ্ছায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়? স্বেচ্ছায় অসুস্থ হয়? সে কি নিজ ইচ্ছায় মরবে? এসব প্রশ্নর উত্তর জানলেই সে তার কাঙ্খিত উত্তরটি পেয়ে যাবে।
এরপর আমরা বলব, কিছু কাজ মানুষ নিজ ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে করে থাকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن شَاءَ اتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِ مَآبًا﴾ [سورة النبأ: 39]
‘অতএব, যার ইচ্ছা, সে তার পালনকর্তার নিকটে আশ্রয়স্থল তৈরী করে নিক’ (নাবা ৩৯)। তিনি আরো বলেন,
﴿مِنكُم مَّن يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنكُم مَّن يُرِيدُ الْآخِرَةَ﴾ [سورة آل عمران: 152]
‘তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া কামনা করে আর কেউ আখেরাত কামনা করে’ (আলে-ইমরান ১৫২)।
পক্ষান্তরে কিছু কিছু কাজে মানুষের নিজস্ব কোন ইখতিয়ার থাকে না; সেগুলি নিছক তাক্বদীরের কারণেই ঘটে। যেমনঃ অসুস্থতা, মৃত্যু, দুর্ঘটনা।
তবে অসুস্থতা, দুর্ঘটনা ইত্যাদি স্রেফ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হলেও মূলতঃ মানুষই এর জন্য দায়ী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ﴾ [سورة الشورى: 30]
‘তোমাদের উপর যেসব বিপদাপদ আসে, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন’ (শূরা ৩০)। অন্যত্র তিনি বলেন,
﴿أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُم مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىٰ هَٰذَا ۖ قُلْ هُوَ مِنْ عِندِ أَنفُسِكُمْ﴾ [سورة آل عمران: 165]
‘যখন তোমাদের উপর কোন মুছীবত নেমে আসল, অথচ তোমরা তার পূর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে উপনীত হয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল? তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের নিজেদের পক্ষ থেকেই নেমে এসেছে’ (আলে-ইমরান ১৬৫)। তিনি আরো বলেন,
﴿مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ۖ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ﴾ [سورة النساء: 79]
‘তোমার যে কল্যাণ হয়, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় । আর তোমার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় তোমার নিজের কারণে’ (নিসা ৭৯)। ইবনে জারীর (রহেমাহুল্লাহ) সূরা শূরার উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘তোমাদের পাপাচারের কারণেই শাস্তিস্বরূপ তোমাদের উপর এমন মুছীবত নেমে আসে’।
অনুরূপভাবে মানুষের যেসব কল্যাণ সাধিত হয়, সেগুলিও তাদের কারণেই রহমত স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে থাকেন। আল্লাহ নূহ (‘আলাইহিস্সালাম)-এর ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,
﴿فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا﴾ [سورة نوح: 10-12]
‘অতঃপর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্য উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন’ (নূহ ১০-১২)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে অছিয়ত করতে গিয়ে বলেন, তুমি আল্লাহ্র দ্বীনের হেফাযত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাকে হেফাযত করবেন।
অনেকেই আবার প্রশ্ন করে, মানুষের পথভ্রষ্টতা বা হেদায়াত প্রাপ্তিসহ সবকিছু যদি আল্লাহ্র হাতেই থাকে, তাহলে মানুষের আর আমল করার কি আছে?
জবাবে বলব, যে হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য, তাকে আল্লাহ ঠিকই হেদায়াত দান করবেন। পক্ষান্তরে যে পথভ্রষ্ট হওয়ার যোগ্য, তাকে তিনি পথভ্রষ্টই করেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾ [سورة الصف: 5]
‘অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ ফাসিক্ব সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না’ (ছফ ৫)। এখানে আল্লাহ স্পষ্টই বললেন, বান্দা নিজেই নিজের পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ। উল্লেখ্য, বান্দা জানে না যে, তার ভাগ্যে হোদয়াত লেখা আছে নাকি গোমরাহী! তাহলে কেন সে খারাপ পথ বেছে নিয়ে তাক্বদীরের দোহাই দেয়?! সে সৎপথ বেছে নিয়ে কি বলতে পারতো না যে, আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দান করেছেন?
আমরা তাকে বলব, তোমার হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়া না হওয়ার বিষয়টি যেমন সুনির্ধারিত, তেমনি তোমার রিযিক্বও সুনির্ধারিত। তুমি হাযার চেষ্টা সত্ত্বেও তোমার জন্য নির্ধারিত রিযিক্বের সামান্যতম কমও পাবে না বা বেশীও পাবে না। তাহলে কেন তুমি রাত-দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করো? রিযিক্বের অন্বেষণে আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতেও তুমি দ্বিধাবোধ কর না কেন? তুমি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রিযিক্ব আসার অপেক্ষায় বাড়ীতে হাত গুটিয়ে বসে থাক না কেন? দুনিয়া অন্বেষণের কাজে তুমি তোমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় কর; কিন্তু আখেরাত অন্বেষণের কাজে তোমার এত অবহেলা কেন? অথচ দু’টিই তাক্বদীরে লিখিত আছে? তুমি অসুস্থ হলে কেন ডাক্তারের কাছে যাও? সবচেয়ে ভাল চিকিৎসালয় এবং যোগ্য ডাক্তার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা কর কেন? এসব ক্ষেত্রে কেন তুমি তাক্বদীরের উপর নির্ভর করে হাত গুটিয়ে বসে থাক না?
অতএব বুঝা গেল, মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা শক্তি রয়েছে, কেউ তাকে বাধ্য করে না। ফলে সে দুনিয়ার কাজে যেমন ব্যস্ত, তাকে আখেরাতের কাজে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী ব্যস্ত হতে হবে। প্রবৃত্তির তাড়নায় অযথা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিশ্চিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
পাঁচ. পথপ্রদর্শন এবং পথভ্রষ্টকরণ কি একমাত্র আল্লাহ্র হাতে?: আমরা ইতিপূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র অকাট্য বক্তব্য অনুযায়ী, একমাত্র আল্লাহই কাউকে পথ দেখান আবার কাউকে পথভ্রষ্ট করেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿مَن يَشَإِ اللَّهُ يُضْلِلْهُ وَمَن يَشَأْ يَجْعَلْهُ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾ [سورة الأنعام: 39]
‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন’ (আন‘আম ৩৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
﴿يُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ﴾ [سورة المدثر: 31]
‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন’ (মুদ্দাছছির ৩১)। হাদীছে ক্বুদসীতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
«يَا عِبَادِى كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلاَّ مَنْ هَدَيْتُهُ فَاسْتَهْدُونِى أَهْدِكُمْ»
‘হে আমার বান্দারা! আমি যাকে হেদায়াত করেছি, সে ব্যতীত তোমাদের সবাই পথভ্রষ্ট। অতএব, তোমরা আমার নিকট হেদায়াত প্রার্থনা কর; আমি তোমাদেরকে হেদায়াত করব’। এভাবে আরো বহু আয়াত এবং হাদীছ আছে, যেগুলি প্রমাণ করে, হেদায়াত এবং পথভ্রষ্টতা দু’টিই একমাত্র আল্লাহ্র হাতে।
কিন্তু কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আল্লাহই কাউকে পথভ্রষ্ট করেন আবার তিনিই তাকে শাস্তি দিবেন, এতে কি যুলম প্রমাণিত হয় না?!
আল্লাহ্র ন্যায়-ইনছাফের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা মোটেই উচিৎ নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনেক জায়গায় স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, তিনি কারো প্রতি তিল পরিমাণও যুলম করেন না। যেমনঃ তিনি বলেন,
﴿وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾ [سورة فصلت: 46]
‘আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলমকারী নন’ (ফুছছিলাত ৪৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا﴾ [سورة الكهف: 49]
‘তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি যুলম করবেন না’ (কাহ্ফ ৪৯)।
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ বান্দাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, কর্মশক্তি, সুষ্ঠু বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে এবং ইসলামী স্বভাবের উপরে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করে এবং নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম) প্রেরণের মাধ্যমে তার সামনে হক্ব ও বাতিল দু’টি পথই তুলে ধরেছেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا﴾ [سورة الدهر: 3]
‘আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হোক, না হয় অকৃতজ্ঞ হোক’ (দাহ্র ৩)। কিন্তু এতকিছুর পরও যখন সে স্বেচ্ছায় গোমরাহীর পথ বেছে নিয়েছে, তখন সে আল্লাহ্র তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং আল্লাহ তার দায়িত্বভার তার স্কন্ধেই তুলে দিয়েছেন। ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এটিই হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক কাউকে পথভ্রষ্ট করার অর্থ এবং এতে আল্লাহ্র ন্যায়-ইনছাফ প্রমাণিত হয়। কেননা আল্লাহ কারো দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তির উপরেই তা চাপিয়ে দিলে সে নিশ্চিত পথভ্রষ্ট হবে। সেজন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবে দো‘আ করতে বলতেন,
«فَلاَ تَكِلْنِى إِلَى نَفْسِى طَرْفَةَ عَيْنٍ»
‘আপনি আমাকে আমার নিজের উপর এক পলকের জন্যও ছেড়ে দিবেন না’।
পক্ষান্তরে আল্লাহ কর্তৃক কাউকে হেদায়াত দানের অর্থ হচ্ছে, তাকে তাওফীক্ব দেওয়া এবং কল্যাণকর কাজে তাকে সহযোগিতা করা। সেজন্য সত্যিকার অর্থে কেউ হেদায়াত প্রত্যাশী হয়ে তদ্নুযায়ী প্রচেষ্টা চালালে আল্লাহ তার সামনে কল্যাণের দুয়ার খুলে দেন। আর এতে মহান আল্লাহ্র রহমত এবং অনুকম্পাই প্রমাণিত হয়।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, মহান আল্লাহ বান্দাকে এককভাবে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে বলেছেন, বরং এই উদ্দেশ্যেই তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাকে ইসলামী স্বভাব দিয়েই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু সে আল্লাহ্র উদ্দেশ্য এবং তার নিজস্ব সৃষ্টিগত স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ করার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন।
শায়খ ফাওযান (হাফেযাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। যে ব্যক্তি হেদায়াত ও কল্যাণ পেতে চায় এবং তা পাওয়ার জন্য আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ তার জন্য অনুগ্রহ করে তার হেদায়াতের পথ সহজ করে দেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿فَأَمَّا مَنْ أَعْطَىٰ وَاتَّقَىٰ, وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَىٰ, فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَىٰ﴾ [سورة الليل: 5-7]
‘অতএব, যে দান করে, আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব’ (লায়ল ৫-৭)। পক্ষান্তরে যে হেদায়াত প্রাপ্তি কামনা করে না; বরং হেদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহ তার এমন ঔদ্ধত্য আচরণের শাস্তিস্বরূপ তার জন্য গোমরাহীর পথ সহজ করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَأَمَّا مَن بَخِلَ وَاسْتَغْنَىٰ, وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَىٰ, فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَىٰ﴾ [سورة الليل: 8-10]
‘আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব’ (লায়ল ৮-১০)। সেজন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে বলেন,
﴿وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
‘আর আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২৫৮, আলে ইমরান ৮৬, তওবাহ ১৯ ও ১০৯, জুমু‘আহ ৫, ছফ ৭)। তিনি আরও বলেন,
﴿وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾
‘নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২৬৪, তওবাহ ৩৭)। তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾
‘আর আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ১০৮, তওবাহ ২৪ ও ৮০, ছফ ৫)। দেখা গেল, তাদের যুলম, কুফরী ও পাপাচারের কারণেই আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত করেন না। অতএব, বান্দা নিজেই নিজের পথভ্রষ্টের জন্য দায়ী এবং সে নিজেই নিজের উপর যুলম করে। এরশাদ হচ্ছে,
﴿وَمَا ظَلَمَهُمُ اللَّهُ وَلَٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾ [سورة النحل: 33]
‘আল্লাহ তাদের প্রতি অবিচার করেননি; বরং তারাই স্বয়ং নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল’ (নাহ্ল ৩৩)।
ধরা যাক দুই ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের একজন মসজিদে প্রবেশ করল। কিন্তু অপরজন গেল নাইট ক্লাবে! তাহলে আল্লাহ কি নাইট ক্লাবে গমনকারীর প্রতি যুলম করলেন?! কখনই না, আল্লাহ্র কসম করে বলছি, তিনি তার প্রতি যুলম করেন নি। কারণ তিনি তাকে সেখানে যেতে বাধ্য করেন নি। বরং আল্লাহ উভয়ের মনের গতি সম্পর্কে সম্যক অবগত। অতএব মসজিদে প্রবেশকারীর মনের কথা জেনেই তিনি তাকে মসজিদে প্রবেশের পথ সহজ করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নাইট ক্লাবে গমনকারীর সেখানে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জেনেই তিনি ঘৃণা এবং রাগ সত্ত্বেও তার পথও সহজ করে দিয়েছেন। বুঝা গেল, আল্লাহ কারো প্রতি সামান্যতম যুলম করেন না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَٰكِنَّ النَّاسَ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾ [سورة يونس 44]
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি সামান্যতম যুলম করেন না, কিন্তু মানুষ নিজেই নিজের উপর যুলম করে’ (ইউনুস ৪৪)।
ছয়. ঝুলন্ত (معلق) এবং অনড় (مثبت أو مبرم) তাক্বদীর প্রসঙ্গ: কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ যদি তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী সবকিছু লিখে থাকেন, তাহলে নিম্নোক্ত আয়াতটির অর্থ কি? এরশাদ হচ্ছে,
﴿يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ﴾ [سورة الرعد: 39]
‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)। অনুরূপভাবে মানুষের হায়াত-মউত, রিযিক্ব যদি সুনির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে নিম্নোক্ত হাদীছের অর্থ কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
‘যে ব্যক্তি তার রূযীর প্রশস্ততা এবং আয়ূ বৃদ্ধি কামনা করে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে’।,
জবাবে বলা যায়, তাক্বদীর দুই প্রকার:
এক. অনড় তাক্বদীর: উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকারের তাক্বদীরে কোন পরিবর্তন হয় না।
দুই. ঝুলন্ত তাক্বদীর: ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট লিখিত তাক্বদীর এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকার তাক্বদীরে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং রিযিক্ব, আয়ূ লাউহে মাহফূযে অনড় রয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ফেরেশতামণ্ডলীর দফতরে লিখিত রিযিক্ব, আয়ূ ইত্যাদিতে পরিবর্তন হতে পারে।
ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, মানুষের আয়ূ দুই ধরনের: এক ধরনের আয়ূ অনড়, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। দ্বিতীয় প্রকারের আয়ূ কোন শর্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে। এর আলোকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠে,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
মহান আল্লাহ ফেরেশতাকে বান্দার আয়ূ লেখার নির্দেশ দেন এবং তাঁকে বলে দেন, বান্দা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তুমি তার বয়স এত বছর বাড়িয়ে দিও। কিন্তু তার বয়স বাড়বে কি বাড়বে না সে বিষয়ে ফেরেশতা কিছুই জানেন না। কেবল আল্লাহই তার সুনির্দিষ্ট বয়স সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তারপর তার মৃত্যু এসে গেলে আর সময় দেওয়া হয় না। তাঁকে মানুষের রিযিক্ব কম-বেশী হয় কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রিযিক্ব দুই প্রকার: এক প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে কেবলমাত্র আল্লাহই জ্ঞান রাখেন এবং এই প্রকারের রিযিক্বে কোন পরিবর্তন হয় না। দ্বিতীয় প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে অবহিত করান। এই প্রকারের রিযিক্ব কম-বেশী হওয়ার বিষয়টি বান্দার কর্মের উপর নির্ভর করে।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাফেয ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেরেশতাকে বলা হয় যে, অমুক আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তার বয়স হবে ১০০ বছর। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার বয়স হবে ৬০ বছর। কিন্তু আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে নাকি ছিন্ন করবে। সেজন্য আল্লাহ্র জ্ঞানে যা রয়েছে, তার কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু ফেরেশতার জ্ঞানে যা রয়েছে, তাতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)। সুতরাং মিটিয়ে দেওয়া বা বহাল রাখার বিষয়টি ঘটে ফেরেশতার জ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে যা রয়েছে, তাতে তেমনটি ঘটে না। আর লাউহে মাহফূযের সবকিছুই আল্লাহ্র জ্ঞানে রয়েছে। প্রথম প্রকারকে বলা হয়, অনড় তাক্বদীর এবং দ্বিতীয় প্রকার হল, ঝুলন্ত তাক্বদীর। সেজন্য ‘ঝুলন্ত তাক্বদীর’ও মূলতঃ আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঝুলন্ত নয়; বরং সেটিও অনড়।
সাত. তাক্বদীরের প্রতিটি সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা কি যরূরী?: ওলামায়ে কেরাম এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, অনাকাংখিত যে কোন বিপদাপদ, বালা-মুছীবতে ধৈর্য্যধারণ করা অপরিহার্য। ফলে বিপদাপদ এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে না, অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। অধৈর্য্য হয়ে ক্রোধান্বিত হওয়া, বুক চাপড়ানো, চুল ছেড়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নেহায়েত অন্যায়। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ্র সিদ্ধান্তে বিচলিত হওয়া, আপত্তি পেশ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিপদাপদে ধৈর্য্যধারণের সাথে সাথে সন্তুষ্ট হওয়াও কি অপরিহার্য? এর সঠিক জবাব হচ্ছে, সন্তুষ্ট হওয়া অপরিহার্য নয়; বরং উত্তম। কারণ শরী‘আতে বিপদাপদে সন্তুষ্ট থাকা অপরিহার্য মর্মে কোন নির্দেশ আসেনি। তাছাড়া বেশীর ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সেটি অসম্ভবও বটে।
তবে দোষ-ত্রুটি, অন্যায়-অপকর্ম ইত্যাদিতে সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয়; বরং সেগুলিকে ঘৃণা করে পরিত্যাগ করতে হবে।
শায়খ উছায়মীন (রহেমাহুল্লাহ) আরো স্পষ্ট এবং সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, অনাকাঙ্খিত বালা-মুছীবতের ক্ষেত্রে বান্দার নিম্নোক্ত চার ধরনের অবস্থান হয়ে থাকেঃ
এক. অসন্তোষ প্রকাশ: এই প্রকারের অবস্থান হারাম; বরং তা কবীরাহ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। গালে আঘাত করা, চুল উপড়ানো, জামা ছেড়া, নিজের ধ্বংস কামনা করা ইত্যাদি বালা-মুছীবতে অসন্তোষ প্রকাশের অন্যতম নিদর্শন।
দুই. ধৈর্য্যধারণ: আর ধৈর্য্যধারণের অর্থ হচ্ছে নিজের মন, মুখ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অসন্তোষ প্রকাশের নিদর্শনসমূহ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা। বালা-মুছীবতের ক্ষেত্রে এই প্রকারের অবস্থান অপরিহার্য।
তিন. সন্তুষ্ট হওয়া: ধৈর্য্যধারণ করা এবং সন্তুষ্ট হওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ধৈর্য্যধারণকারী বালা-মুছীবতকে হযম করে নেয় ঠিকই, কিন্তু তার মনের ভেতরে সেটি কঠিন এবং কষ্টদায়ক হিসাবেই গণ্য হয়। পক্ষান্তরে সন্তুষ্ট প্রকাশকারী সেটিকে কষ্টদায়কই মনে করে না; বরং সে মানসিকভাবে খুশী এবং প্রশান্ত হয়। সে মনে করে, তার কিছুই হয়নি। ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ)সহ বেশীরভাগ বিদ্বানের নিকট বালা-মুছীবতে সন্তুষ্ট হওয়া যরূরী নয়; বরং উত্তম।
চার. শুকরিয়া আদায় করা: অর্থাৎ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করা এবং বিপদটিকে নে‘মত মনে করা। কেউ বলতে পারে, কিন্তু এটি কিভাবে সম্ভব? আমরা বলব, আল্লাহ কাউকে তাওফীক্ব দিলে সেটি অসম্ভব কিছু নয়। কারণ:
প্রথমত: যখন সে জানবে যে, এই বিপদ তার পাপের কাফফারাহ স্বরূপ এবং পরকাল পর্যন্ত পাপের শাস্তিকে বিলম্বিত করার চেয়ে ইহকালে শাস্তি হয়ে যাওয়া উত্তম, তখন তার জন্য এই বিপদ নে‘মতে পরিণত হবে এবং এর কারণে সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করবে।
দ্বিতীয়ত: মুছীবতে ধৈর্য্যধারণ করলে বান্দাকে উত্তম প্রতিদান দেওয়া হয়। এরশাদ হচ্ছে,
﴿إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾ [سورة الزمر: 10]
‘ধৈর্য্যধারণকারীদেরকে অগণিত পুরষ্কার প্রদান করা হয়’ (যুমার ১০)। সুতরাং এই কথা স্মরণ করে সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করবে।
তাক্বদীর কেন্দ্রিক প্রচলিত কিছু ভুল-ভ্রান্তি
আমাদের সমাজে কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি প্রচলিত আছে, যেগুলি তাক্বদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী। এসব ভুল-ভ্রান্তি মানুষ কখনও কথায়, কখনও কাজে আবার কখনও বিশ্বাসে করে থাকে। তাক্বদীর সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসআলাতে আমরা এ জাতীয় ২/১টি ভুল-ভ্রান্তির কথা উল্লেখ করেছি। নীচে প্রচলিত আরো এরূপ কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরা হলঃ
১. তাক্বদীর বিরোধী কথাবার্তা বলাঃ যেমন: বিপদাপদ এলে কেউ কেউ তাক্বদীরকে মেনে না নিতে পেরে বলে, হে আল্লাহ! আমি কি করেছি? অথবা বলে, আমি এমন ফলাফলের যোগ্য নই! অনুরূপভাবে কেউ কেউ কারো বিপদ এলে তার উদ্দেশ্যে বলে, বেচারার এমন বিপদ হল, অথচ সে এমন মুছীবতের যোগ্য নয়; তাক্বদীর তার প্রতি অবিচার করেছে!
এসব তাক্বদীর বিরোধী কথাবার্তা। সবকিছুতে যে আল্লাহ্র হিকমত রয়েছে, সে সম্পর্কে তার অজ্ঞতা থাকার কারণেই সে এমন কথাবার্তা বলে। কেননা আল্লাহ বান্দার কাছ থেকে যা নিয়েছেন বা তাকে যা দিয়েছেন, সবইতো একমাত্র তাঁরই। তাঁর প্রত্যেকটি কর্মে রয়েছে হিকমত এবং রহস্য, যা বান্দা জানে না। অতএব, এ জাতীয় বাক্য ব্যবহার বর্জন করতে হবে।
২. মুছীবত এলে ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করাঃ সম্পদ নষ্ট, শস্য-ফসলের ক্ষতি, সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত হলে অথবা অন্য যে কোন বিপদাপদ এলে চিন্তিত, রাগান্বিত ও বিরক্ত হয়ে অনেকেই বলে, যদি আমি এমন করতাম, তাহলে এমনটি হত না অথবা, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে এমন হত! আমি যদি সফর না করতাম, তাহলে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতাম!
এ ধরনের বাক্য ব্যবহার মারাত্মক ভুল এবং ব্যক্তির অজ্ঞতার পরিচায়ক। কারণ মুছীবতে বান্দাকে ধৈর্য্যধারণ এবং তওবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করলে বান্দার আফসোস এবং দুশ্চিন্তা বাড়া ছাড়া কমে না। তাছাড়া এতে তাক্বদীরের বিরোধিতার ভয়তো থেকেই যায়।
সেকারণেই আল্লাহ মুনাফিক্বদেরকে ভর্ৎসনা করে তাদের এ ধরণের বাক্য তুলে ধরে বলেন,
﴿لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَّا قُتِلْنَا هَاهُنَا﴾ [سورة آل عمران: 154]
‘আমাদের যদি কিছু করার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ (আলে ইমরান ১৫৪)।
﴿الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا﴾ [سورة آل عمران: 168]
‘তারা হলো ঐসব লোক, যারা (যুদ্ধে না যেয়ে) বসে থাকে এবং তাদের ভাইদের সম্বদ্ধে বলে, যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না’ (আলে ইমরান ১৬৮)। আল্লাহ তাদের এ জাতীয় কথার জবাব দিয়েছেন এভাবে,
﴿قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾ [سورة آل عمران: 168]
‘তাদেরকে বলে দিন, এবার তোমরা তোমাদের নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (আলে ইমরান ১৬৮)।
আমরা কোন কিছু অর্জনের যথারীতি প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও যদি তা অর্জন করতে না পারি, তাহলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রদর্শিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে। তিনি বলেছেন, এমতাবস্থায় তোমাদের কেউ যেন না বলে, ‘আমি যদি এমন এমন করতাম’। বরং সে যেন বলে,
«فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ قَدَرُ اللهُِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ»
‘এটিই আল্লাহ নির্ধারিত তাক্বদীর এবং তিনি যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। কেননা ‘যদি’ শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়’।
হাদীছটিতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হল যে, কোন কিছু ঘটে যাওয়ার পরে ‘যদি’ কোন ফায়দা দেয় না। সুতরাং তাক্বদীরের উপর খুশী থাকতে হবে এবং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এর প্রতিদানের প্রত্যাশী হতে হবে। সাথে সাথে ভবিষ্যতে আরো ভাল কিছু অর্জনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
তবে বিপদাপদ ছাড়াই কল্যাণকর কোন কিছুর আশা করে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করা যায়। যেমনঃ আল্লাহ যদি আমাকে ধন-সম্পদ দিতেন, তাহলে তাঁর পথে অনেক ব্যয় করতাম। গতকাল যদি আমি ক্লাসে যেতাম, তাহলে অনেক উপকৃত হতাম।
৩. তাক্বদীর বিরোধী কার্যকলাপ করাঃ যেমন: বিপদাপদ এলে সহ্য করতে না পেরে কাপড় ছেড়া, চুল ছেড়া, বুক চাপড়ানো, গালে আঘাত করা, বিলাপ করা, বদ দো‘আ করা, ধ্বংস কামনা করা ইত্যাদি। এগুলি সবই জাহেলী এবং তাক্বদীর বিরোধী কর্মকাণ্ড।
৪. মৃত্যু কামনা করাঃ অনেকেই বালা-মুছীবতে ধৈর্য্যধারণ না করতে পেরে নিজের মৃত্যু কামনা করে। কিন্তু এটি মস্ত বড় ভুল, কোন মুমিনের জন্য মৃত্যু কামনা করা বৈধ নয়। তবে কেউ যদি মৃত্যু কামনা করেই, তাহলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশিত নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে কামনা করতে হবে:
«اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِى وَتَوَفَّنِى إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِى»
‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনি ঐসময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখুন, যে পর্যন্ত আমার জন্য আমার যিন্দেগী কল্যাণকর হয়। আর আপনি আমাকে ঐ সময়ে মৃত্যু দান করুন, যখন মারা গেলে মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর হয়’।
আল্লামা আব্দুর রহমান সা‘দী (রহেমাহুল্লাহ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, অসুস্থতা, দরিদ্রতা, ভয়-ভীতি ইত্যাদি বিপদাপদে মৃত্যু কামনা করতে হাদীছটিতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এরূপ মৃত্যু কামনার মধ্যে অনেকগুলি ক্ষতি রয়েছে। তন্মধ্যে: ক. বিপদাপদে বান্দাকে ধৈর্য্য ধরতে বলা হয়েছে; কিন্তু মৃত্যু কামনা করে সে এই নির্দেশের খেলাফ করে। খ. এমন মৃত্যু কামনা মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। তাকে অলস ও নিস্তেজ করে ফেলে এবং তার হৃদয়ে হতাশার অনুপ্রবেশ ঘটায়। গ. মৃত্যু কামনা করা চরম বোকামী এবং অজ্ঞতা। কারণ সে জানে না যে, মৃত্যুর পরে তার কি হবে। হতে পারে, যে সমস্যা থেকে সে মুক্তি পেতে চাইছে, মৃত্যুর পরে তাকে তার চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে ইত্যাদি।
৫. আত্মহত্যা করাঃ কেউ কেউ বিপদাপদ, দুঃখ-দুর্দশা ইত্যাদিতে জর্জরিত হয়ে জীবনের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার জন্য আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ বেছে নেয়। কিন্তু এটি তাক্বদীর এবং আল্লাহ্র সিদ্ধান্তে আত্মসমর্পণের সম্পূর্ণ বিরোধী। মহান আল্লাহ এমন জঘন্য কর্মকে হারাম করেছেন এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তির জন্য কঠোর শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا, وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا﴾ [سورة النساء: 29-30]
‘আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন এবং যুলমের বশবর্তী হয়ে এরূপ করবে, তাকে অচিরেই আমরা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। আর ইহা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজসাধ্য’ (নিসা ২৯-৩০)। ভেবে দেখুন, দুনিয়ার বালা-মুছীবত থেকে নিষ্কৃতির আশায় কোন মর্মন্তুদ শাস্তির দিকে সে পা বাড়ায়!
৬. কন্যা সন্তান জন্ম নিলে নারায হওয়াঃ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কতিপয় মানুষ জাহেলী যুগের অজ্ঞ মানুষদের মত আচরণ করে। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে মুখ কালো করে ফেলে। মেডিকেল-ক্লিনিকে গেলে আপনি এমন ভূরি ভূরি দৃশ্য দেখতে পাবেন। ছেলে হলে ডাক্তার-নার্সরাও খুব খুশী হয়ে খবরটি পরিবেশন করেন; কিন্তু মেয়ে হলে ব্যাপারটি ঘটে সম্পূর্ণ উল্টা। এটি সম্পূর্ণ তাক্বদীর বিরোধী এবং জাহেলী আচরণ। মহান আল্লাহ জাহেলী যুগের এহেন আচরণের নিন্দা করে বলেন,
﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِالْأُنثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ, يَتَوَارَىٰ مِنَ الْقَوْمِ مِن سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ ۚ أَيُمْسِكُهُ عَلَىٰ هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ ۗ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ﴾ [سورة النحل: 58-59]
‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং সে অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে সে (বাঁচিয়ে) রাখবে নাকি তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে। জেনে রেখো, তাদের সিদ্ধান্ত খুবই নিকৃষ্ট’ (নাহ্ল ৫৮-৫৯)। এর আরো কিছু ক্ষতির দিক রয়েছে। যেমন: ক. এমন আচরণের অর্থ হল, আল্লাহ্র উপঢৌকন ফেরৎ দেওয়া; অথচ উচিৎ ছিল সাদরে এই উপহার গ্রহণ করা এবং আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ্র ক্রোধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এই একটি পয়েন্টই যথেষ্ট। খ. এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারী জাতির মান-সম্মানে আঘাত করা হয়। গ. এমন আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজের অজ্ঞতা, মূর্খতা, বোকামি এবং স্বল্প বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। ঘ. এতে জাহেলী যুগের মানুষদের আচরণের সাথে সাদৃশ্যের বিষয়টিতো রয়েছেই।
মানুষ জানে না, কিসে তার জন্য অধিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাছাড়া মেয়েরাই হচ্ছে মা, বোন, স্ত্রী এবং তারাই সমাজের অর্ধেক। আর বাকী অর্ধেক হচ্ছে পুরুষ, কিন্তু তাদেরকে গর্ভে ধারণ করে মেয়েরাই। ফলে পুরো সমাজটাই যেন মেয়েদের সমাজ।
তাদের মর্যাদা বর্ণনায় কুরআন এবং হাদীছে অনেক বক্তব্য এসেছে। আল্লাহ বলেন,
﴿يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ﴾ [سورة الشورى: 49]
‘তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র উপহার দেন’ (শূরা ৪৯)। এখানে আল্লাহ মেয়েদেরকে পুরুষদের আগে উল্লেখ করেছেন এবং উভয়কে উপহার হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«مَنِ ابْتُلِىَ مِنَ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ»
‘যাকে কয়েকটি কন্যা সন্তান দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, অতঃপর সে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করে, ঐ ব্যক্তির জন্য তার কন্যারা জাহান্নাম থেকে প্রতিবন্ধক হয়’।
৭. হিংসা করাঃ হিংসা একটি দূরারোগ্য ব্যাধি। খুব কম মানুষই এথেকে বেঁচে থাকতে পারে। সেজন্য বলা হয়,
لاَ يَخْلُوْ جَسَدٌ مِنْ حَسَدٍ؛ وَلَكِنَّ اللَّئِيْمَ يُبْدِيْهِ، وَالْكَرِيْمَ يُخْفِيْهِ
‘কেউই হিংসা মুক্ত নয়। তবে হীন মনের মানুষ তা প্রকাশ করে; কিন্তু মহৎ ব্যক্তি তা গোপন রাখে। হিংসুক কর্তৃক হিংসিত ব্যক্তির কল্যাণকর কোন কিছুর পতন কামনা অথবা হিংসুক কর্তৃক হিংসিত ব্যক্তির কল্যাণকর কোন কিছু প্রাপ্তিকে অপছন্দ করার নাম হিংসা।
হিংসা তাক্বদীর বিরোধী জঘণ্য আচরণ। কেননা হিংসুক আল্লাহ্র সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয়। সে যেন বলতে চায়, অমুক যোগ্য নয়, তদুপরি তাকে দেওয়া হল! অমুক পাবার যোগ্য, অথচ তাকে মাহরূম করা হল! ভাবখানা এরূপ যে, হিংসুক তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করে আল্লাহকে পরামর্শ দিচ্ছে! সে এমন আচরণের মাধ্যমে আল্লাহ্র ফায়ছালার দুর্নাম করে!
অতএব সর্বপ্রকার হিংসা বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ্র সবকিছুতে প্রভূত কল্যাণ এবং হিকমত রয়েছে।
৮. আল্লাহ্র উপর কসম করাঃ যেমন: কেউ কারো সম্পর্কে বলল, আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ অমুককে ক্ষমা করবেন না। আমাদের সমাজে এমনটি অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়। এমনকি ভাল মানুষ কর্তৃকও কখনও কখনও এমন ঘটনা ঘটে। ধরা যাক, কেউ কাউকে ভাল কাজের দা‘ওয়াত দিল, কিন্তু সে তার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পাপকাজে নিমজ্জিত থাকল। এমতাবস্থায় এই দাঈ নিরাশ হয়ে তাকে উপদেশ দেওয়া ছেড়ে দেয়; বরং হয়তোবা তার উদ্দেশ্যে বলে, আল্লাহ্র কসম! কস্মিনকালেও আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না।
মনে রাখতে হবে, এ ধরণের বাক্যের ব্যবহার খুবই ভয়াবহ। ইহা একদিকে যেমন আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ, অন্যদিকে তেমনি তাক্বদীর বিরোধী। কেননা হেদায়াত আল্লাহ্র হাতে। তাছাড়া মানুষের শেষ ভাল হবে কি মন্দ হবে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। এমন বাক্য ব্যবহারকারীকে কে বলেছে যে, আল্লাহ ঐ পাপীকে ক্ষমা করবেন না? আল্লাহ্র রহমত আটকানোর অপচেষ্টা করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে?!
হাদীছে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«أَنَّ رَجُلاً قَالَ وَاللَّهِ لاَ يَغْفِرُ اللَّهُ لِفُلاَنٍ وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَالَ مَنْ ذَا الَّذِى يَتَأَلَّى عَلَىَّ أَنْ لاَ أَغْفِرَ لِفُلاَنٍ فَإِنِّى قَدْ غَفَرْتُ لِفُلاَنٍ وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ»
‘এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ অমুককে ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহ বললেন, আমার উপর কসম করে কে বলে যে, আমি অমুককে ক্ষমা করব না? (সে জেনে রাখুক!) আমি অমুককে ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তোমার আমল নষ্ট করে দিয়েছি’।
তাক্বদীর বিষয়ে একজন মুমিনের করণীয়ঃ
বান্দাকে তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং শরী‘আতের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। বান্দা সৎকর্ম করলে আল্লাহ্র প্রশংসা করবে। আর অন্যায় কিছু করে ফেললে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। কারণ আমাদের আদি পিতা আদম (‘আলাইহিস্সালাম) পাপ করে আল্লাহ্র নিকট তওবা করেছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁর তওবা কবূল করেছিলেন এবং তাঁকে নবী হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। পক্ষান্তরে ইবলীস পাপকে আঁকড়ে ধরে ছিল। ফলে আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেছেন এবং তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। অতএব যে পাপ করে তওবা করবে, সে প্রকৃত মানুষ হিসাবে পরিগণিত হবে। কিন্তু যে পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দিবে, সে ইবলীসী কর্মকাণ্ডের ধ্বজাধারী হবে। সৌভাগ্যবান সে-ই, যে তার পিতার অনুসরণ করবে। আর দুর্ভাগা সে-ই, যে তার শত্রু ইবলীসের অনুসরণ করবে।
একজন মুমিনকে তাক্বদীরের চারটি স্তরের উপর বিশ্বাস করতে হবে। সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, আল্লাহ্র জ্ঞান, লিখন, ইচ্ছা এবং সৃষ্টির বাইরে কোন কিছুই ঘটে না। সে আরো বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তাকে তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। ফলে সে সৎকাজ করে যাবে এবং পাপাচার বর্জন করে চলবে। আল্লাহ তাকে সৎকাজ করার এবং অসৎকাজ বর্জন করার তওফীক্ব দিলে সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করবে। পক্ষান্তরে সৎকাজ সম্পাদন এবং অসৎকাজ বর্জনের তওফীক্বপ্রাপ্ত না হলে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং তওবা করবে।
ইহলৌকিক সুযোগ-সুবিধা অর্জনেও বান্দাকে প্রচেষ্টা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক এবং বৈধ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সে তার কাঙ্খিত বস্তুটি অর্জন করতে পারলে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করবে। আর না পারলে তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। সাথে সাথে তাকে বিশ্বাস করতে হবে, তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে সঠিক কিছু করবে, তাহলে তা কখনই ভুল হওয়ার নয়। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে ভুল করবে, তাহলে তা কখনই সঠিক হওয়ার নয়।
মনে রাখতে হবে, তাক্বদীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান রাখা সবার জন্য যরূরী নয়। সংক্ষিপ্তাকারে মৌলিক বিষয়গুলি জেনে নিলেই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
তাক্বদীর সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের
কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বাণীঃ
* আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, একদিন তাঁর সামনে তাক্বদীরের কথা বলা হলে তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলদ্বয় তাঁর মুখের মধ্যে প্রবেশ করালেন। অতঃপর ঐ আঙ্গুলদ্বয় দ্বারা হাতের তালুতে দু’টি দাগ দিলেন এবং বললেন,
«أَشْهَدُ أَنَّ هَاتَيْنِ الرَّقْمَتَيْنِ كَانَتَا فِي أُمِّ الْكِتَابِ»
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এই দাগ দু’টিও আল্লাহ্র তাক্বদীরের মূল কিতাব তথা লাওহে মাহফূযে লেখা ছিল’।
* আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,
«لاَ واَللهِ لاَ يَطْعَمُ رَجُلٌ طَعْمَ الْاِيْمَانِ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ»
‘আল্লাহ্র কসম! তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কেউ ঈমানের স্বাদ পাবে না’।
* আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন,
«الْعَجْزُ وَالْكَيْسُ مِنَ الْقَدَرِ»
‘অপারগতা এবং বিচক্ষণতা তাক্বদীরেরই অংশ’।
* ত্বাঊস (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তিনশ’ ছাহাবীকে পেয়েছি, তাঁরা সকলেই বলেন,
«كُلُّ شَيْءٍ بِقَدَرٍ»
‘সবকিছু তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়’।
* ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,
«مَا غَلاَ أَحَدٌ فِي الْقَدَرِ إِلاَّ خَرَجَ مِنَ الإِسْلَامِ»
‘তাক্বদীর নিয়ে যে-ই বাড়াবাড়ি করেছে, সে-ই ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে’।
* তিনি আরো বলেন,
«لَيْسَ قَوْمٌ أَبْغَضَ إَلَى اللهِ مِنَ الْقَدَرِيَّةِ»
‘আল্লাহ্র নিকট ক্বাদারিইয়াদের চেয়ে ঘৃণিত আর কোন সম্প্রদায় নেই’।
* একদা ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কে বলা হয়েছিল, একদল লোক বলে যে, তাক্বদীর বলতে কিছু নেই। তখন তিনি বলেছিলেন,
«أُولَئِكَ الْقَدَرِيُّونَ. أُولَئِكَ مَجُوسُ هَذِهِ الْأُمَّةِ»
ওরাই হল ক্বাদারিইয়াহ সম্প্রদায়, ওরাই এই উম্মতের মাজূসী বা অগ্নিউপাসক’।
* হাসান বাছরী (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাক্বদীরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, সে কাফের হয়ে যাবে’।
* ইমামু আহলিস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ইমাম আহমাদ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ক্বাদারিইয়াহ, মু‘তাযিলাহ এবং জাহ্মিইয়াদের পেছনে ছালাত আদায় করা যাবে না’।
তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপনের কতিপয় উপকারিতাঃ
১. তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করলে ঈমান পূর্ণতা পায়।
২. তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনলে ‘রুবূবিইয়াত’ বা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করার বিষয়টি পূর্ণতা পায় না। কেননা তাক্বদীর আল্লাহ্র কর্মসমূহের অন্যতম।
৩. তাক্বদীরে বিশ্বাস করলে বান্দা তার বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্টে আল্লাহ্র শরণাপন্ন হতে পারবে। পক্ষান্তরে কল্যাণকর কিছু ঘটলে সে তা আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করতে শিখবে এবং সে জানবে যে, তার প্রতি আল্লাহ্র অশেষ অনুগ্রহেই এটি সম্ভব হয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ»
‘মুমিনের বিষয়টি অনেক মজার, তার সবকিছুই কল্যাণকর; মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। কারণ খুশীর কিছু ঘটলে সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। পক্ষান্তরে কষ্টের কিছু ঘটলে সে ধৈর্য্যধারণ করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়’।
৪. তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করলে বান্দা যে কোন বিপদাপদকে হালকা মনে করতে শিখবে। কারণ যখন সে জানবে যে, তার বিপদাপদ আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আসে, তখন তা তার কাছে কিছুই মনে হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَن يُؤْمِن بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ﴾ [سورة التغابن: 11]
‘যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন’ (তাগাবুন ১১)। আলক্বামা (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যার বিপদাপদ আসলে সে বিশ্বাস করে যে, তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই হয়েছে। ফলে সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাকে অকপটে গ্রহণ করে নেয়।
৫. তাক্বদীরের মাধ্যমে মানুষ তাকে প্রদত্ত নে‘মতসমূহকে সেগুলির প্রকৃত দাতার দিকে সম্বন্ধিত করতে পারবে। কেননা আপনি তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনলে উক্ত নে‘মতের সাথে প্রকাশ্যে জড়িত কোন ব্যক্তির দিকে সেগুলির সম্বন্ধ করবেন। সেজন্য অনেক মানুষকে রাজা-বাদশা, মন্ত্রী-এমপিদের তোষামোদ করতে দেখা যায়। অতঃপর তাঁদের কাছ থেকে কিছু অর্জন করতে পারলে উহাকে তাঁদের দিকেই সম্বন্ধিত করে এবং সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহের কথা ভুলে যায়। অবশ্য একথা ঠিক যে, মানুষের কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে হবে।
৬. তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করলে সুখে-দুঃখে সর্বদা সঠিক পথের উপরে টিকে থাকা সম্ভব হবে। ভাল কিছু পেলে সে আনন্দে আত্মহারা হবে না। পক্ষান্তরে বালা-মুছীবত তাকে আশাহত করতে পারবে না। সে জানবে, তার জীবনে কল্যাণকর যা কিছুই অর্জিত হয়, সবই আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই হয়; তার বিচক্ষণতা এবং কর্মের পারদর্শিতার বিনিময়ে নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا بِكُم مِّن نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ﴾ [سورة النحل: 53]
‘তোমাদের নিকট যে সমস্ত নে‘মত আসে, তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আসে’ (নাহ্ল ৫৩)।
পক্ষান্তরে বিপদাপদ এলে সে জানবে, এটিই তার তাক্বদীরে লিপিবদ্ধ ছিল এবং তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পরীক্ষা। ফলে সে ধৈর্য্যহারা হবে না, আশাহত হবে না; বরং সে ধৈর্য্যধারণ করবে এবং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ছওয়াবের প্রত্যাশী হবে।
বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ, ‘রাসূল’ নামক গ্রন্থের লেখক বোডলি (BODLEY) বলেন, ‘আমি মরুর আরবদের কাছ থেকে দুশ্চিন্তাকে পরাজিত করতে শিখেছি। কারণ মুসলিম হিসাবে তাক্বদীরের প্রতি তাদের ঈমান অটুট। আর এই ঈমান তাদেরকে যেমন নিরাপদে জীবন যাপন করতে সহযোগিতা করেছে, তেমনি তা তাদেরকে সহজ এবং সাবলীল জীবন যাপন করতে শিখিয়েছে। সেজন্য কোন বিষয়ে তারা তাড়াহুড়াও করে না; দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয় না। কেননা তারা বিশ্বাস করে, তাক্বদীরে যা লেখা আছে, তা হবেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে।...আমার আরব মরুভূমি ছেড়ে আসা ১৭ বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজও আল্লাহ নির্ধারিত তাক্বদীরের ক্ষেত্রে আমি আরবদের সেই পরিচিত অবস্থান গ্রহণ করি। ফলে যেকোন বিপদাপদকে আমি ঠাণ্ডা মাথায় বরণ করে নিতে পারি। আরবদের কাছ থেকে শেখা এই স্বভাব আমার স্নায়ুবিক চাপ নিয়ন্ত্রণে উপশমকারী নানা ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের চেয়ে বহুগুণ বেশী সফল হয়েছে।
৭. তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনলে পরকালের সুখ-শান্তির জন্য বান্দা সর্বাত্মক চেষ্টা করতে সক্ষম হবে; ব্যর্থতা আর হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারবে না।
৮. তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, জালিয়াতি প্রবণতাসহ অনেক মনের ব্যাধির চিকিৎসা হিসাবে কাজ করে। কেননা সে তার কোন ভাইকে নে‘মতের মধ্যে দেখলে, নিশ্চিত জানবে যে, আল্লাহই তাকে এই নে‘মত দান করেছেন। ফলে হিংসার পরিবর্তে সে তার মুসলিম ভাইয়ের নে‘মতে খুশী হবে এবং আল্লাহ্র কাছে নিজের জন্য অনুরূপ নে‘মত প্রাপ্তির প্রার্থনা করবে। আল্লাহ্র প্রতি ঈমান না আনলে মনের এজাতীয় ব্যাধির চিকিৎসা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং তদনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনার তাওফীক্ব দিন। আমীন!
0 Comments